মিথুন আশরাফ – এক রাতে বিশ্ব ফুটবলের দুই সেরা দলের খেলা হয়। দুই দলই জিতলে স্বপ্নের ম্যাচ দেখার মিলত। সেমিফাইনালে লড়াই হতো। কিন্তু একদল বিদায় নিল, ব্রাজিল। আরেকদল সেমিফাইনালে উঠে গেল, আর্জেন্টিনা। তাতে করে ব্রাজিলের বিদায়ে নেইমারের কান্নাভেজা রাতের দেখা মিলে। আর আর্জেন্টিনার জয়ে মেসির উল্লাস, উৎসব দেখার মিলে। নেইমারের কান্নাভেজা রাতে বন্ধু মেসি জিতে, সেমিফাইনালে উঠে উল্লাস করেন।
টাইব্রেকারে ব্রাজিলকে বিদায় করে দিয়ে সেমিফাইনালে উঠে ক্রোয়েশিয়া। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায় শুরু হওয়া ম্যাচে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে ক্রোয়েশিয়া। খেলায় ব্রাজিলের পক্ষে নেইমার গোল করেন। আর ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে ব্রুনো পেটকভিচ গোল করেন। টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক লিভাকভিচ একটি বল আটকে দেন। আরেকটি গোল মিস করে ব্রাজিল। ক্রোয়েশিয়া ৪ টি গোলই করে।
প্রথমার্ধে দুই দলের কেউ গোল করতে পারেনি। আক্রমন পাল্টা আক্রমন চলে। তবে ক্রোয়েশিয়াই ব্রাজিলের ডিবক্সে বেশি আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয়ার্ধেও কোন গোল হয়নি। খেলা অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে গড়ায়। অতিরিক্ত সময়ের ১৫ মিনিটও শেষ হয়। বাড়তি যে মিনিট পাওয়া যায়, তাতেই গোল দেন নেইমার। ১০৬ মিনিটে গোলরক্ষককে কাটিয়ে অসাধারণ গোল দেন নেইমার (১-০)। ব্রাজিল এগিয়ে যায়।
ম্যাচের যখন ১১৭ মিনিট, তখন ব্রুনো পেটকভিচ দুর্দান্ত গোল করে খেলায় সমতা আনেন (১-১)। খেলা টাইব্রেকারে গড়াচ্ছে, তা বোঝা হয়ে যায়। তাই হয়। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে ১-১ সমতায় খেলা শেষ হয়। শেষ দিকে ক্রোয়েশিয়া গোল করে দেয়। টাইব্রেকারে প্রথম গোল ব্রাজিল মিস করে। ক্রোয়েশিয়া গোলরক্ষক লিভাকভিচ আটকিয়ে দেন। আরেকটি গোল মিস হয় ব্রাজিলের। তাতেই ব্রাজিলের ফুটবলারদের কান্নাভেজা রাতের শুরু হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে রাত ১ টায় টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে ২০১৪ সালের পর আবার সেমিফাইনালে উঠে আর্জেন্টিনা। নির্ধারিত মিনিটের খেলায় আর্জেন্টিনার পক্ষে নাহুয়েল মলিনা ও লিওনেল মেসি গোল করেন। নেদারল্যান্ডসের পক্ষে জোড়া গোল করেন ওয়াট ওয়েগহর্স্ট। ২-২ খেলা ড্র থাকে। টাইব্রেকারে খেলা নিষ্পত্তি হয়। টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক মারটিনেজ নেদারল্যান্ডসের প্রথম দুটি শট আটকে দিয়েই আর্জেন্টিনাকে জেতান।
আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে প্রথমার্ধে ৩৫ মিনিটেই গোল পায় আর্জেন্টিনা। মেসির অসাধারণ পাসে ডিবক্সে পায়ের ছোয়ায় গোল করেন মলিনা (১-০)। প্রথমার্ধ শেষ হয় আর্জেন্টিনার ১ গোল দেওয়াতেই। দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নেমে ৬২ মিনিটে মেসি গোল পেয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু হয়নি। ফ্রি কিক থেকে শট নেন মেসি। তা গোলপোস্টে লেগে ফিরে আসে। গোলটি হলে আরও এগিয়ে যেত আর্জেন্টিনা। তবে খুব বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি। ৭১ মিনিটে একটি ফাউল থেকে পেনাল্টি পেয়ে ৭৩ মিনিটে গোল করেন মেসি। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। ৮৩ মিনিটে নেদারল্যান্ডস গোল ব্যবধান কমায়। ওয়াট ওয়েগহর্স্ট গোল করেন (২-১)।
খেলায় হাতাহাতি হয়। বার বার মারামারি লাগার মতো অবস্থাও হয়। উত্তেজনা চরমে উঠে। মেসিরা জিতেই যাচ্ছিলেন। অতিরিক্ত ১০ মিনিট দেওয়া হয়। শেষ মিনিটে গিয়ে গোল করেন ওয়েগহর্স্ট। তাতে ২-২ সমতা আসে। ডিবক্সের বাইরে থেকে ফ্রি কিক পেয়ে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা দেখিয়ে গোল করে নেদারল্যান্ডস। এই সমতা নিয়ে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে।
অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের ১৫ মিনিট খেলা ড্র থাকে। আক্রমন পাল্টা আক্রমন চলে। শেষ মিনিটে গিয়ে মেসিদের একটি বল নেদারল্যান্ডসের গোলপোস্টে লাগে। দুর্ভাগ্য মেসিদের! ১২০ মিনিট খেলাও ড্র হয়।
টাইব্রেকারে খেলা গড়ায়। প্রথমেই নেদারল্যান্ডসের দুই শট আটকে দেন আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক মারটিনেজ। মেসি এসে গোল করেন। আর্জেন্টিনা টানা দুই গোল করে। এরপরের গোলটি আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস করে। চারনম্বর গোলটি আর্জেন্টিনারও মিস হয়। পঞ্চম গোলটি নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনা করলে মেসিরা ৪-৩ গোলে জিতে সেমিফাইনালে উঠে যায়।
এবার বিশ্বকাপের ২২তম আসরে শুরুতেই হোচট খায় আর্জেন্টিনা। সৌদি আরবের কাছে হেরে যায়। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়ার শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সৌদি আরবের কাছে ১-২ গোলে হেরে যায়। এরপর যে ঘুরে দাড়ায় আর্জেন্টিনা, মেসির ছন্দে শুধু জিতেই চলেছে। শেষ ষোলতে নাম লেখাতে হলে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে হারাতেই হতো আর্জেন্টিনাকে। দুই দলকেই ২-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। দাপটের সঙ্গেই জিতে। ৬ পয়েন্ট নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের গ্রুপ সেরা হয়েই শেষ ষোলতে খেলতে নামে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও জয় পায়। অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। লুসাইল স্টেডিয়ামে নেদারল্যান্ডসকেও হারিয়ে দেয়। সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে। নেদারল্যান্ডসকে বিদায় করে দেয়।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে সেমিফাইনাল ম্যাচ হয়েছিল। আর্জেন্টিনাকে টাইব্রেকারে জিততে হয়েছিল। সেবার ৪-২ গোলে জিতেছিল মেসিরা। এবার ৪-৩ গোলে জিতে।
এখন আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে লড়াই করবে। মঙ্গলবার রাত ১ টায় দুই দলের সেমিফাইনাল ম্যাচ হবে। প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে। তাতেই আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে সেমিফাইনাল হবে।
মেসির সামনে আর দুটি ম্যাচ। একটি সেমিফাইনাল। তা জিতলে ফাইনাল। সেমিফাইনাল জেতার পর ফাইনাল জিতলেই বিশ^চ্যাম্পিয়ন হবে আর্জেন্টিনা। প্রথমবারের মতো মেসির হাতে বিশ্ব শিরোপা শোভা পাবে। ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে। এখন বাকি আছে আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ ফুটবল প্রেমীদের মনে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাই বেশি জায়গা করে রেখেছে। ব্রাজিল বিদায় নেয়ায় এখন আর্জেন্টিনাই ভরসা। শেষপর্যন্ত মেসির হাতেই শিরোপা উঠুক, সেই আশাই এখন করা হচ্ছে। নেইমারের কান্নাভেজা রাতে মেসির উৎসব হয়েছে। এখন এই উৎসব ১৮ ডিসেম্বর ফাইনাল ম্যাচে জেতার পর্যন্ত থাকুক, সেই প্রত্যাশাই করা হচ্ছে।