Search
Close this search box.

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

মিরাজ, শান্ত দ্যুতিতে ইংল্যান্ডকে সিরিজে হারিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস

মিথুন আশরাফ

বাংলাদেশ প্রথমবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোন সিরিজ জিতবে, এই আশা নিয়ে দর্শকে ভরপুর হয়ে যায় স্টেডিয়াম। দর্শকদের মন ভরানোর মতো নৈপুন্যই দেখান বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। ৪ উইকেট শিকার করা মেহেদি হাসান মিরাজ তো অসাধারণ বোলিং করেন। এরপর ব্যাট হাতেও দেখান ঝলক। করেন ২০ রান। মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুন্যের সঙ্গে ব্যাট হাতে নাজমুল হোসেন শান্তর অপরাজিত ৪৬ রানে ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ৪ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। তাতে করে ইংল্যান্ডকে প্রথমবার কোন সিরিজে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে এক ম্যাচ হাতে রেখেই ২-০ ব্যবধানে জিতে গেছে বাংলাদেশ।

মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে টস জিতে আগে ফিল্ডিং করে বাংলাদেশ। ৯ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। করে ১১৭ রান। বেন ডাকেট সবচেয়ে বেশি ২৮ রান করতে পারেন। ওপেনার ফিল সল্ট করেন ২৫ রান। মিরাজ একাই নেন ৪ উইকেট। বাংলাদেশের যে বোলারই বল করতে আসেন, উইকেট পান। তাতে করে ঐক্যবদ্ধ নৈপুন্যে ইংল্যান্ড বেশিদুর যেতে পারেনি। জবাব দিতে নেমে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৮.৫ ওভারে ১২০ রান করে জিতে বাংলাদেশ। নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত ৪৬, মেহেদি হাসান মিরাজ ২০ ও তৌহিদ হৃদয় ১৭ রান করেন।

ম্যাচটিতে বাংলাদেশের ৮ বোলার বোলিং করেন। এরমধ্যে মিরাজ দ্যুতি ছড়ান। একই ৪ ওভার বোলিং করে ১২ রান দিয়ে ৪ উইকেট শিকার করেন। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৪ উইকেট নেন মিরাজ। এরআগে গতবছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপক্ষে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন মিরাজ। মিরাজের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ছিল সেটি। এবার সবকিছুকে ছাপিয়ে যান মিরাজ। দেশের ডানহাতি স্পিনার হিসেবে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের (৫/২০) পর মিরাজ দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ৪ উইকেট শিকার করে নেন। বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও ঝলক দেখান মিরাজ। ইনিংসের দুটি ছক্কাই হাকান মিরাজ। সেই সাথে ১৬ বলে ২ ছক্কায় ২০ রান করেন মিরাজ। মিরাজের বোলিং-ব্যাটিং দ্যুতির সঙ্গে হাফসেঞ্চুরি করে প্রথম টি-টোয়েন্টি জেতানো শান্তর ৪৭ বলে ৩ চারে করা অপরাজিত ৪৬ রানে ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে হারিয়ে ইতিহাস গড়া গেছে।

বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে শুরুটাও ইংল্যান্ডের মতই হয়। দলের ১৬ রানেই প্রথম উইকেটের পতন ঘটে। টানা ৫ ম্যাচে ব্যর্থ হওয়া ওপেনার লিটন কুমার দাস (৯) আউট হয়ে যান। দলের ২৭ রানে ওপেনার রনি তালুকদারও (৯) সাজঘরে ফিরেন। পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ ২ উইকেট হারিয়ে ৩২ রান করতে পারে।

দুই উইকেট পড়ার পর নাজমুল হোসেন শান্ত ও তৌহিদ হৃদয় মিলে দলকে ৫০ রানে নিয়ে যান। ৯.৩ ওভারে ৫০ রান স্কোরে যোগ হয়। দল যখন ৫৬ রানে যায়, তখন ১৭ রান করে হৃদয় আউট হন। এরপর প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৫১ রান করে দলকে জেতানো শান্ত ও মিরাজ মিলে অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকেন।

মিরাজ তো ইনিংসের প্রথম ছক্কাও হাকান। দ্বিতীয় ছক্কাটিও মিরাজই হাকান। সুইপ করে মিডউইকেট দিয়ে মিরাজের ছক্কা দেখতেও কী অসাধারণ লাগে। যদিও ২০ রানের বেশি করতে পারেননি মিরাজ। আউট হয়ে যান। তবে শান্তর সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ৪১ রানের জুটি গড়েন। তাতেই দল শতরানের কাছে চলে যায়। জয়ের কাছেও চলে যায়। ১৬.৩ ওভারে ১০০ রান করে বাংলাদেশ। এমন সময় সাকিব আল হাসান আউট হয়ে যান। তাতে একটু সমস্যা তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা জাগে।

অবশ্য শান্ত উইকেটে থাকেন। তাই ভরসাও থাকে। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে তিনিই জেতান। কিন্তু দলের ১০৫ রানে যখন আফিফ হোসেন ধ্রুবকে (২) আউট করে দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করে নেন জোফরা আর্চার, তখন শঙ্কা জেগে যায়। শেষ ১২ বলে জিততে বাংলাদেশের ১৩ রান লাগে।

ক্রিস জর্ডান বোলিং করতে আসেন। শান্ত বাউন্ডারি হাকান। দুই রানও নেন। তাতে করে ১০ বলে জিততে ৭ রান লাগে। তৃতীয় বলে ১ রান হয়। ৯ বলে জিততে ৬ রান লাগে। চতুর্থ বলে তাসকিন আহমেদও বাউন্ডারি হাকিয়ে দেন। ৮ বলে জিততে ২ রান লাগে। তাসকিন বাউন্ডারি হাকিয়ে জিতিয়ে দেন। শান্ত ৪৬ ও তাসকিন ৮ রানে অপরাজিত থাকেন। ৭ বল বাকি থাকতে ১২০ রান করে জিতে বাংলাদেশ।

প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৬ উইকেটে জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি জিতলেই ইতিহাস গড়া হত সাকিববাহিনীর। বাংলাদেশ সব দলকেই কোন না কোন ফরমেটের সিরিজে হারায়। শুধু ইংল্যান্ডকেই কোন ফরমেটের সিরিজে হারাতে পারেনি। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি জিতলেই সিরিজ জয়ের সঙ্গে ইতিহাসও গড়া হতো। প্রথমবার ইংল্যান্ডকে কোন এক ফরমেটের সিরিজে হারানোর স্মৃতি নিজেদের করে নিত। তাতে করে ক্রিকেট খেলুড়ে সব দলকেই কোন না কোন ফরমেটে সিরিজে হারানোর ইতিহাস গড়াও হয়ে যেত। ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেয়া ১১৮ রানের টার্গেট সহজেই করে ফেলে জিতে বাংলাদেশ।

ইংল্যান্ডের ১৬ রান হতেই তাসকিন আহমেদের বলে আউট হয়ে যান ডেভিড মালান। তৃতীয় ওভারে তাসকিন নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে এসে মঈন আলীকেও আউট করে দিতে পারতেন। কিন্তু প্রথম স্লিপে কঠিন ক্যাচটি ধরতে পারেননি নাজমুল হোসেন শান্ত। এরপর দুইবার রান আউটের সুযোগ কাজে লাগানো যায়নি। না হলে ২২ রানের মধ্যেই ৩ উইকেট হারাত ইংল্যান্ড।

ওপেনার ফিল সল্ট ও মঈন যেন কাঁপন ধরাতে থাকেন। পাওয়ার প্লে’র শেষ ওভারে, ষষ্ঠ ওভারে নাসুম আহমেদ নিজের প্রথম ওভার করতে আসেন। মঈন স্লগ সুইপ করে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে ম্যাচের প্রথম ছক্কা হাকান। তবে সাকিব আল হাসান নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই দেখান ঝলক। তৃতীয় বলেই সল্টকে (২৫) কট এন্ড বোল্ড করে দেন। দ্বিতীয় উইকেটে সল্ট ও মঈনের জুটিকে ৩৪ রানের বেশি করতে দেননি সাকিব।

হাসান মাহমুদও প্রথম ওভার করতে এসেই দ্যুতি ছড়ান। শেষ বলে জস বাটলারকে (৪) বোল্ড করে দেন। পাওয়ার প্লেতে ইংল্যান্ড ৫০ রান তুলতেও উইকেট টপাটপ পড়তে থাকে। ৫৫ রানেই ৩ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। মেহেদি হাসান মিরাজও একই কাজ করেন। প্রথম ওভার করতে এসে মঈনকে (১৫) আউট করে দেন। ৫৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে যায় ইংল্যান্ড। চাপেও থাকে। আর তাতে করে ১০ ওভারে ৬৩ রানের বেশি করতে পারেনি ইংল্যান্ড।

পঞ্চম উইকেটে বেন ডাকেট ও স্যাম কারেন মিলে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যান। দুইজন মিলে ৩৪ রানের জুটি গড়েন। যেই দলের রান ৯১ হয়, মিরাজ বোলিং করতে এসে টপাটপ কারেন (১২) ও ক্রিস ওকসকে আউট করে দেন। দুটি আউটই হয় উইকেটরক্ষক লিটন কুমার দাসের স্ট্যাম্পিংয়ে। ১৭ ওভারে ১০০ রান করে ইংল্যান্ড। হারায় আরও একটি উইকেট।

এবার মিরাজ নিজের শেষ ওভার করতে এসে ক্রিস জর্ডানকে (৩) আউট করে দিয়ে ৪ উইকেট শিকার করে নেন। ইনিংসের শেষ ওভারে বেন ডাকেটকে (২৮) আউট করে দেন মুস্তাফিজুর রহমান। শান্ত অসাধারণ ক্যাচ ধরেন। টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত রেহান আহমেদ (১১) রান আউট হন। শেষ বলে গিয়ে জোফরা আর্চারও রান আউট হয়ে গেলে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ১১৭ রানের বেশি করতে পারেনি।

বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের শুরুটা হয় ২০০৫ সালে। জিম্বাবুয়েকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হারিয়ে শুরুটা করে বাংলাদেশ। এরপর ২০০৬ সালে কেনিয়াকে ৪ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে। একই বছর স্কটল্যান্ডকে ২ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে আয়ারল্যান্ডকে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথমবার ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে দেয় বাংলাদেশ। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে পাকিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে।

একই বছর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবার হারিয়ে দেয়। ২০১৬ সালে আফগানিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে ওয়ানডে সিরিজে হারায়। একইবছর অস্ট্রেলিয়াকে ৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৪-১ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। তাতে করে ইংল্যান্ড ছাড়া সব দলকেই কোন না কোন ফরমেটে সিরিজে হারানোর স্বাদ বাংলাদেশ পেয়েছে। এখন ইংল্যান্ডকে হারালেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডকে এখন পর্যন্ত কোন ফরমেটেই বাংলাদেশ হারাতে পারেনি। এবার সেই সুযোগ ধরা দেয়। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ১৫৬ রান করেও হেরেছে ইংল্যান্ড। এবার তো টার্গেট ১১৮ রান। তা করতেই পারলেই ইতিহাস গড়া হতো বাংলাদেশের। জিতে ইতিহাস গড়লোও বাংলাদেশ। তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার দুপুর ৩ টায় শুরু হবে। এই ম্যাচে জিতলে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশও করা হয়ে যাবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ