ড. প্রণব কুমার পান্ডে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর করছেন তখন দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল বিএনপি এই সফরকে কীভাবে দেখছে তার ওপর। যদিও এটি প্রত্যাশিত ছিল যে বিএনপি এই সফরকে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করবে, তারপরেও জনগণের দৃষ্টি সেদিকে ছিল। যেটি কল্পনা করা হয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই গত ৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সরকারকে চরমভাবে ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন এই সফরের মাধ্যমে সরকার ভারতের সঙ্গে দেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারেনি। বরং তিস্তাসহ যে সমস্ত অমীমাংসিত বিষয় ছিল সেগুলোতে ঐক্যমতে না পৌঁছাতে পারাকে সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে বিএনপি। এমনকি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে লাইন অব ক্রেডিট-এর আওতায় ভারত থেকে ৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার পাওয়ার কথা থাকলেও তার অল্প সামান্য কিছু অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার কারণে পুরো অর্থ পাওয়া যায়নি।
একই সাথে বিএনপি নেতৃবৃন্দ দাবি করেন যে– ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান এবং ভারতের সাথে বিএনপির সবসময় ভালো সম্পর্ক বজায় ছিল। যা সত্যিকার অর্থেই অসত্য দাবি। এই ধরনের বক্তব্য একটি অপপ্রচার, কারণ ভারত-বিরোধিতা বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর রাজনীতির মূলমন্ত্র। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান করেছিল, ঠিক তেমনিভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দার শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে পুনরায় ভারত বিরোধিতা শুরু হয়েছিল।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই বিরোধিতা চরমে পৌঁছেছিল। ৯০ এর দশকে রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা কার্ডটি খুব বেশি ব্যবহৃত হতে দেখেছি আমরা। সেই সময় ভোট আসলেই এই জোটের পক্ষ থেকে বলতে শুনেছি যে ‘ভারতের বিভিন্ন স্থানে নৌকা টাঙানো রয়েছে’, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে ঢাকা হবে দিল্লি’ কিংবা ‘মসজিদগুলো হিন্দুদের উপসনালয়ে পরিণত হবে’। এ ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভারত বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী বীজবপণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিএনপির ভারত-বিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাদের শাসনামলে। কারণ এই সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের খুবই কম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
আমরা সবাই জানি যে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মাত্র ২২ বছর দেশ শাসন করেছে। অন্যদিকে, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া মিলে প্রায় ২৪ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প সময়ের (১৯৭২-১৯৭৫) শাসনামলে ভারতের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি এবং ভারত-বাংলা যৌথ নদী কমিশনের মর্যাদা চুক্তিসহ আটটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে, জিয়ার অধীনে (১৯৭৭-১৯৮১) বিমান পরিষেবা এবং ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্সসহ মাত্র দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন (১৯৮২-১৯৯০) সময়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করতে পারেনি। খালেদা জিয়া তার দুই মেয়াদে (১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) ভারত সরকারের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হননি। ভারত সরকারের সাথে এই সরকারগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়া থেকে বোঝা যায় যে এই সরকারগুলো পাকিস্তান এবং চীনের পক্ষে ভারত-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। যদি তারা তা না করতো, হয়তো দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশীর (যাদের সাহায্য স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময়ে অপরিহার্য ছিল) সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতো।
বিপরীতে, ক্ষমতায় থাকাকালীন (১৯৯৬-২০০১)সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দশক পুরনো গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিসহ তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ২০০৯-২০১৫ সাল পর্যন্ত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং উন্নয়ন সহযোগিতার একটি কাঠামো চুক্তিসহ ২২টি চুক্তি সম্পাদন করেছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যায় যে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক রেখেছে।
এমনকি বঙ্গবন্ধু অথবা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যখন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারতের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছে তখনও তারা সেই সমস্ত চুক্তির বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ভারতের সাথে ‘সামরিক এবং কৌশলগত বন্ধুত্ব চুক্তি সম্পাদন করে’ তখন এই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সে চুক্তিকে ‘দাসত্ব চুক্তি’ হিসেবে বলা হয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ভারতের সাথে বহুদিনের অমীমাংসিত গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে তখন সেটির সমালোচনা করা হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যখন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে তখনও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলটি ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনাক জাহান তার বই ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল’-এ বলেছেন যে এই রাজনৈতিক অবস্থানগুলো বিএনপির ঐতিহ্যগত ভারত-বিরোধিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল যা জিয়ার অধীনে এর অন্যতম ভিত্তি ছিল’।
সাউথ ডাকোটার ব্ল্যাক হিলস স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আহরার আহমেদ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই রকম জটিলতা রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ বইয়ের একটি নিবন্ধে পাজ এবং ট্রুডোর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দুই দেশের মধ্যে একদিকে, একটি মহান এবং গৌরবময় সভ্যতার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে যা বাংলাদেশও তার নিজস্ব ঐতিহ্য হিসাবে দাবি করতে পারে, আবার অর্থনৈতিক পরিপূরকতা রয়েছে যা উভয় দেশ পারস্পরিক সুবিধার জন্য অন্বেষণ করতে পারে; বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের যথেষ্ট অবদানের জন্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং কৃতজ্ঞতা রয়েছে।’
ফলে বন্ধুপ্রতীম দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব দূর করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে যার মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।
বিএনপির ভারত বিরোধী অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময়। তখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ নির্ধারিত থাকলেও হরতালের অজুহাতে সেই সময় বেগম খালেদা জিয়া তাঁর সাথে দেখা করেননি যা ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত একটি বিষয়। এর মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ভারত আওয়ামী লীগের বন্ধু, তাই ভারতের সাথে বিএনপির কোনোরকম সখ্যতা হতে পারে না। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বাংলাদেশকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যেহেতু ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী এবং বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধুমাত্র এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়ই দেয়নি, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেই রাষ্ট্রের সাথে বৈরিতা কখনোই বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
বিএনপির মূল সমস্যা হচ্ছে তাদের পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি। যেহেতু বিএনপি পাকিস্তান এবং চীনপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, এবং ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের বৈরিতার রয়েছে, তাই তারা কখনোই ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। এর আরেকটি মূল কারণ হলো যে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এবং সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, অতএব ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। তারা যতই ভারতের কাছে যাবার চেষ্টা করুক না কেন, ভারত হয়তো তাদের গ্রহণ করবে না যেটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। এর কারণ হলো দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারিত হয় কৌশলগত এবং দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। কোন দল সেখানে ক্ষমতায় রয়েছে সেটি মুখ্য বিষয় নয়।
২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসে তখন বিএনপি খুব উৎফুল্ল ছিল এই ভেবে যে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো হবে না কারণ ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই অল্পসময়ের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে যে জিনিসটি স্পষ্ট করেছেন সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু এবং দুই বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হলে দক্ষিণ এশিয়ায় একদিকে যেমন দুটি দেশে স্থায়িত্ব আসবে ঠিক তেমনিভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে সকলের সাথে বন্ধুত্ব। এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি, কোনও নির্দিষ্ট দলের পররাষ্ট্রনীতি নয়।
আমরা সবাই জানি যে করোনা অতিমারী পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বিশ্বের সব দেশসহ বাংলাদেশ এবং ভারত চেষ্টা করে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার। বর্তমানে পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। ভারত যেহেতু বাংলাদেশের অত্যন্ত কাছের প্রতিবেশী এবং ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে অতএব ভারত বিরোধিতার কার্ড ব্যবহার করে রাজনীতি করলে সেটি বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই ভারত-বিরোধিতা বিএনপি এবং তাদের গোষ্ঠীদের রাজনীতির একটি মূলমন্ত্র। তবে সময়ের আবর্তে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ঘনঘন সফরের ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতা কিছুটা কমেছে। যদিও একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী সবসময় চেষ্টা করে চলেছে এটিকে উসকে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপচেষ্টা খুব কার্যকর হবে না বলেই জনগণ বিশ্বাস করে। দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া শান্তি এবং প্রগতি বজায় থাকবে– এটিই হোক সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়