বিভুরঞ্জন সরকার
১৩ নভেম্বর ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২-এর ফাইল ম্যাচ। ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের অনেকের ধারণা ছিল ম্যাচে পাকিস্তান জিতবে। কিন্তু তা হয়নি। ১৩৭ রানের পাকিস্তানকে আটকে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। ৫ উইকেটে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে ইংল্যান্ড বাংলাদেশের অনেকের মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে পাকিপ্রেমিক ক্রিকেট দর্শকের সংখ্যা বেড়ার লক্ষণ স্পষ্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিকে খেলার সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতাও বেড়েছে। রাজনীতির মাঠে এক দল আরেক দলকে মোকাবিলা করার কথা বলতে গিয়েও বলা হচ্ছে ‘খেলা হবে’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখে ‘খেলা হবে’ কথাটি ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে।
১৩ নভেম্বর ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিজয়ের মাসে বিএনপি বিশৃঙ্খলা করতে চায়, সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পাঁয়তারা করছে। বাঁশের লাঠিতে জাতীয় পতাকা, এটা আমরা হতে দেবো না। খেলা হবে, সেই খেলায় তারা (বিএনপি) পরাজিত হবে। আন্দোলনে পরাজিত হবে’। একই দিন জাতীয় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন। সবাই যদি সমান সুযোগ না পায়, তাহলে ভোটের পরিবেশ থাকবে না। তিনি আরও বলেছেন, রাজনীতিতে খেলা হচ্ছে। কাজেই মাঠে থাকতে হবে। মাঠে না এসে তো বলতে পারবে না নির্বাচনের পরিবেশ নেই।
সব দল আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে বলে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, এখনো নির্বাচনের ১৪ মাস বাকি। এ সময় অনেক পরিবর্তন হবে বলে তিনি মনে করেন। নির্বাচনে অনেক রকম ক্যালকুলেশন (হিসাব-নিকাশ) হয়। সেই ক্যালকুলেশন এখনো বাকি। অবশ্য সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি শেষ কথা আগেই বলে দিয়ে এখন বারবার সেই কথার প্রতিধ্বনি করছে। কথাটি হলো, বিএনপি বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে দলীয় মহাসমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আজকের এই লাখো জমায়েত বুঝিয়ে দিয়েছে, আন্দোলন কী। সরকার পতনের ডাক শুরু হয়েছে। আমরা আর ঘরে ফিরে যাবো না। সরকার পতন নিশ্চিত করেই ঘরে ফিরবো’। বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে নতুন কৌতুকের জন্ম দিয়েছে। ‘সরকার পতন নিশ্চিত না হলে ঘরে ফিরবো না’ বলে তিনি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন? এখন কি তিনি ঘরের বাইরে থাকেন? এর আগে বিএনপির আরেক নেতা বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে।
১০ ডিসেম্বরের পর নাকি তারেক রহমানও দেশে ফিরে আসবেন। বিএনপি নেতাদের এসব বক্তব্য দলীয় কর্মীদের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে তা জানি না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা এগুলোকে কথার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবছেন না। বিএনপির বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশে নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ভালো জমায়েত হচ্ছে, এটা ঠিক। যেসব কৌশল করে সমাবেশে জনসমাগম কম করার চেষ্টা সরকার করছে তা আসলে সরকার ও সরকারি দলের জন্য খুব ভালো হচ্ছে না। প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে যে জনভোগান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে বদনাম হচ্ছে সরকারেরই। পুলিশের একটি শাখার এক গোপন প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, যেকোনো কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে কর্মসূচি আহ্বানকারী রাজনৈতিক দল যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় বেশি। এতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কিছুটা হলেও কমে। সরকারের ভুল কৌশলের কারণে গণমাধ্যমে প্রচার ও কিছু মানুষের সহানুভূতি পেয়ে বিএনপি ধরে নিয়েছে, সরকার বুঝি পরাজিতের আচরণ শুরু করেছে। কেউ কেউ এমনও ভাবছেন যে বিএনপির হুমকিতে আওয়ামী লীগ ভয় পেয়েছে। তবে রাজনীতির সদর-অন্দরের খবর যারা রাখেন, তারা এটা মনে করছেন না যে সরকার ভয় পেয়েছে।
বরং এটাই হয়তো ঠিক যে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ মাঠে শক্তি পরীক্ষায় নামবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে ‘খেলা হবে’ বলছেন সেটা অকারণ না-ও হতে পারে। বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের আছে। অতীতে বিএনপি আন্দোলন করে সফল হয়েছে, তার কোনো রেকর্ড নেই। বিএনপি সরকারে থাকতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে দাবি আদায় করেছে কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি আন্দোলন করে কোন দাবিটা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে? ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য জ্বালাও-পোড়াও করেছে, ভোটকেন্দ্রসহ ৫ শতাধিক স্কুল ঘর পুড়িয়েছে, বাসে আগুন দিয়েছে, পেট্রলবোমাসহ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে। তাতে কি নির্বাচন বাতিল হয়েছিল? ২০১৫ সালে ৯৩ দিন তারা অবরোধের নামে জ্বালা-পোড়াও পেট্রলবোমা মারাসহ অসংখ্য যানবাহনে আগুন দিয়েছে, শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। কিন্তু এত কিছুর পরও কি সরকারের পতন হয়েছিল? এবার কয়েকটি মহাসমাবেশ করেই টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আশা বিএনপি করলেও তেমন দুরাশা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা করছেন বলে মনে হয় না।
খেলার জয়-পরাজয় নিয়ে খেলার আগে যে উত্তেজনা থাকে, খেলার পর তার রেশ এক রকম থাকে না। পাকিস্তান দলের সমর্থকরা ইংল্যান্ড হারবে মনে করলেও হেরেছে পাকিস্তান। তাই পাকিসমর্থকরা খেলা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। অথচ ভারতকে সেমিফাইনালে পাকিস্তান হারানোর পর কতজনের কত উচ্ছ্বাস! ভারত-ইংল্যান্ড খেলার দিন ভারতের পরাজয়ে আমাদের দেশে যারা উল্লাস প্রকাশ করেছেন, তারা কি খেলাপ্রীতি থেকে সেটা করেছেন, না কি ওই উল্লাসের পেছনেও কোনো সূক্ষ্ম রাজনীতি তথা ভারতবিরোধিতা ছিল তা ভেবে দেখার বিষয়। ইংল্যান্ড-পাকিস্তান খেলার দিন পাকিস্তানের পরাজয়ে এই মহলের নীরবতা অর্থহীন নয়।
আমি নিজে খুব ক্রীড়ামোদী নই। ফুটবল বা ক্রিকেট কোনো খেলা নিয়েই আমার কোনো লাগামহীন উচ্ছ্বাস বা উন্মাদনা নেই। সময়-সুযোগ পেলে খেলা দেখি। তবে টিভি সেটের সামনে দীর্ঘ সময় বসে থাকার ধৈর্য থাকে না বলে কোনো খেলাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা হয় না। ফলে ফুটবলে যেমন কোনো বিশেষ দেশ বা দলের প্রতি আমার নিঃশর্ত সমর্থন নেই, তেমনি ক্রিকেটেও। কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জিতলে অবশ্যই উচ্ছ্বসিত হই, আবার হেরে গেলে কষ্ট পাই। অন্য খেলার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু আজকাল বাংলাদেশের কিছু মানুষ যেভাবে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের প্রতি অনুরাগ দেখাচ্ছে, সেটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। কেউ কেউ আছেন যারা খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে চান না। আবার এই ‘কেউ কেউ’ সংখ্যায় কত তা-ও নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ ক্রীড়ামোদী এবং এই ক্রীড়ামোদীদের কত শতাংশ মানুষ খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে চান না, তার কোনো পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। তবে এটা অনুমান করা যায় যে, দেশে ক্রীড়ামোদীর সংখ্যার চেয়ে পাকিস্তানভক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না!
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রযোজন। এটা ঠিক, কে কোন দলকে সমর্থন করবে, কোন খেলোয়াড়ের ফ্যান কে হবে– এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের ব্যাপার। বাংলাদেশের একজন তরুণ বা যেকোনো বয়সের মানুষ যেকোনো দেশের ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সমর্থক হতে পারেন। কেউ যদি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা বা জিম্বাবুয়ের সমর্থক হতে পারেন, তাহলে আরেকজন কেন পাকিস্তানের সমর্থক হতে পারবেন না? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়নি। পাকিস্তান চালিয়েছে। পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। দুই লাখের বেশি বাঙালি নারী পাকিস্তানি সেনাসদস্য এবং তাদের দেশীয় দোসরদের দ্বারা চরম পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানিরা তখন ‘মুসলমান ভাই ভাই’ নীতি অনুসরণ করেনি। ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা না করে সব বাঙালিকে শত্রু ভেবেছে এবং শত্রু নিধনে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছে।
পাকিস্তান যদি একাত্তরে জয়লাভ করতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। পাকিস্তানকে পরাজিত করেই বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই অন্য দেশের সমর্থক হওয়া আর পাকিস্তানের সমর্থক হওয়া এক কথা নয়। আমাদের হারতে দেখলে (শুধু খেলার মাঠে নয়) যারা খুশি হয়, তাদের জন্য যারা অন্তরে দরদ পোষে তাদের দেশাত্মবোধ নিয়ে প্রশ্ন জাগাটা অযৌক্তিক নয়। যারা বলেন খেলার মাঠের বিষয় নিয়ে রাজনীতির ইস্যু বানানো ঠিক নয়। তারা জানেন কি, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার খবর শুনে ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গ্যালারিতে বাঙালি দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। রাজনীতি সবাই করেন না। কিন্তু সবার জীবনই রাজনৈতিক ঘটনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। খেলাধুলাও যে রাজনীতি, রাজনৈতিক পরিবেশের বাইরে নয়, একাধিক ঘটনা দিয়েই তা প্রমাণ করা যায়। খেলার সাথে কেন রাজনীতি জড়িয়ে যায়, কেবল রাজনীতিই নয়, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম জড়িয়ে যায়- সেগুলো বোঝার সক্ষমতা না থাকলে, অন্যকে বোঝানোর সক্ষমতা না থাকলে. আমরা অন্যকে কী দিয়ে প্রভাবিত করবো! ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছি কিংবা পাকিস্তানিদের ‘নৃশংসতা অন্যদের কেন স্পর্শ করা উচিত- এই বোধটা এই মানুষগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল কি না- সেটাও ভাবার চেষ্টার মধ্যে রাখা জরুরি’।
এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। যারা শাসনক্ষমতায় আছেন, তাদের এগুলো নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো গড়ে উঠছে, মানুষের গড় আয়, আয়ু বাড়ছে। আমরা তো এগিয়ে যাওয়ার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, রক্ত নদী সাঁতরে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এখন স্বাধীনতার ৫০ বছরে অনেক দূর আমরা এগিয়েছি। বড় বড় অর্জন অবশ্যই আমাদের আছে। আবার এই সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের পিছুন হটার ঘটনাও আছে। আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখে আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করতে চাইনি। অথচ আজ আমরা ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না। পাকিস্তানিরা মুসলমান আমরাও মুসলমান তাই তাদের জয়ে আমাদের কেউ কেউ উল্লসিত হয়– একাত্তরের রক্তস্মৃতি ভুলে গিয়ে। এটাকে যারা ছোট বিষয় মনে করেন তারা আসলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিতে চান। মানুষকে তার শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে পারলে পরাজিত করা সহজ হয়। আমরা কি সে পথেই হাঁটছি না?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।