ড. প্রণব কুমার পান্ডে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করার মাধ্যমে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলো। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে গত ১৫ বছরের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের জনগণ সরকারের ওপর যথেষ্ট আস্থা রেখেছে। গত তিন মেয়াদে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করেছে। বর্তমান মেয়াদে সরকারের মূল কাজ হওয়া উচিত দেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তরিত করা।
প্রশাসনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি হ্রাস এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত নতুন সরকারের।
২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়েছিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ই-গভর্ন্যান্স প্রবর্তনের মাধ্যমে সেবা বিতরণ প্রক্রিয়াকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সুতরাং সরকারি সেবাগুলো ডিজিটালাইজ করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার প্রশংসার দাবিদার। যেহেতু আমরা একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলেছি, বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টা দেখতে চায়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার দেশের অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে, নতুন সরকারকে অবশ্যই সব স্তরে দুর্নীতি কমানোর লক্ষ্যে কার্যকর নীতি প্রণয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
যেহেতু দুর্নীতি প্রশাসন ও সুশাসনকে দুর্বল করে দেওয়ার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জড়িত, তাই দুর্নীতি বন্ধে প্রশাসনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর নতুন সরকারকে জোর দিতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সামাজিক অবস্থান বা রাজনৈতিক আনুগত্য নির্বিশেষে অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আরও ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া উচিত।
তাছাড়া, সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা নতুন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। দক্ষতা ও জবাবদিহিমূলক একটি সরকারি কাঠামো নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। অতএব, বাহ্যিক প্রভাব নির্বিশেষে, প্রশাসনের সবার দায়িত্ব পালন কার্যকরভাবে নিশ্চিত করার জন্য সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে, সরকারের উচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের সব স্তরের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মতামত প্রদানকে উৎসাহিত করা এবং আইনের নীতিকে সমর্থন করে জনগণের অধিকার রক্ষা করে এমন একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিগত ১৫ বছরে সরকার দেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখন উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টার দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অতএব, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে এমন নীতির বাস্তবায়নকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যাপক নীতির অংশ হিসাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের সংস্থাগুলোর (এসএমই) বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের জন্য অনুকূল এমন একটি ব্যবসায়িক পরিবেশ প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে এমন ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। এই উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একটি শক্তিশালী অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে উঠতে এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।
জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ, শিক্ষাকে একটি জাতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যেকোনও দেশের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। কারণ, শিক্ষা দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, সরকারের উচিত এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা, যাতে প্রতিটি নাগরিক তাদের সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে। একটি যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মশক্তি প্রযুক্তির বিকাশ, উদ্ভাবনের প্রচার এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক শিক্ষা শ্রমশক্তিকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করতে পারে, যা তাদের শ্রম বাজারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম করে গড়ে তোলে। একটি শক্তিশালী বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অনুশীলন দক্ষতা, বিশেষ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং শিল্প-নির্দিষ্ট দক্ষতা প্রদান করতে পারে, যা তারা বাস্তব সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা যায়।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার চাকরির বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্যই কেবল সুবিধা প্রদান করবে না, বরং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে সক্ষম করবে, যা সরকারের বেকারত্বের সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করবে, ফলে এই শিক্ষা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সহায়তা করবে। এটি শিল্প ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করবে, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বৈশ্বিক পরিবর্তন এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে এমন একটি পরিবেশ গড়ে উঠবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
অর্থনীতি ও শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি, একটি দেশের সামাজিক কাঠামোও দেশের সামগ্রিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সুতরাং, আমাদের সবাইকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা মেনে চলতে হবে, যা আমাদের সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ঐতিহাসিকভাবে, বাঙালি এমন একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃত, যারা সহনশীলতা বজায় রাখে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় পটভূমির ব্যক্তিদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে। তবে, একটি গোষ্ঠী প্রায়ই দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য জনগণকে বিভক্ত করার চেষ্টা করে চলেছে। সুতরাং, সরকারকে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় থাকবে এবং একটি গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীর অধিকার ও বিশ্বাসকে সম্মান করবে।
বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সরকারকে অবশ্যই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এই বিষয়গুলোর গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারকে অবশ্যই এমন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা এই উদ্বেগের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো প্রশমিত করতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য টেকসই প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তা প্রদান, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ বিনিয়োগ করা অপরিহার্য।
উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে আমাদের অতীতের অর্জনকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ ব্যাপক উন্নয়ন অর্জন করেছে। ফলে, এই অর্জনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে তাদের অবশ্যই বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরিধি সম্প্রসারণ, দুর্নীতি হ্রাস, প্রশাসনের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বরাদ্দের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ ১৫ বছর ধরে সরকারের প্রতি আস্থা রেখেছে। আমরা আশা করতে পারি যে সরকার যদি এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়িত করতে পারে তবে তারা নাগরিকদের কাছ থেকে আরও বেশি সমর্থন পাবে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।