বিএডিসির পচা বীজে সর্বশান্ত মেহেরপুরের কৃষকেরা

কৃষি ডেস্ক: দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে মেহেরপুর কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। পচা বীজ উৎপাদন থেকে শুরু করে, চুক্তিবদ্ধ কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্য, শ্রমিকদের বিলও লুটপাট করছেন এ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই প্রতিষ্ঠানে প্রণোদনার পচা বীজে মিলছে পোকা। যা জমিতে বপন করে সর্বশান্ত হয়েছে জেলার হাজার হাজার কৃষক। এমনকি জাত পরিবর্তনের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে বিএডিসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামের শাহাজামাল একজন গরীব চাষি। তার নিজের সামান্য জমি আছে। মূলত তিনি অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করেন। গত মে মাসে মেহেরপুরের বিএডিসি অফিস থেকে পাঁচ কেজি প্রণোদনার ধানবীজ পেয়েছিলেন শাহজামাল। আশা করেছিলেন এক বিঘা জমিতে এই বীজ বপন করবেন তিনি। শাহজামালের মতো সারাদেশে প্রণোদনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজার হাজার কৃষককে বিনামূল্যে ধানবীজ বিতরণের করেছিলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। যে বীজগুলো উৎপাদন করেছিলো মেহেরপুর বিএডিসি। বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিলো মেহেরপুরের তিন উপজেলার ১৫ হাজার ৭শ’ জন কৃষককে।

সেই বীজ বাড়িতে নিয়ে এসে শাহজামাল তার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন যাছাই বাছাই করতে। ঝাড়তে গিয়ে শাহজামালের স্ত্রী দেখতে পান বীজের মধ্যে অসংখ্য পোকা। বিএডিসির থেকে শাহজামালের পাওয়া বিনামূল্যের বীজ শেষ পর্যন্ত যায় হাঁস মুরগীর পেটে। একই গল্প জানা যায় অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের সঙ্গে কথা বলে।

এই খারাপ ধানবীজের কারণে শাহজামালের আউশ ধানের চাষাবাদ পিছিয়ে গিয়েছিলো দেড় মাস। পরে খোলাবাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করে আবাদ করেন তিনি। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার কারণে তিন ফসলী জমির সার্বিক আবাদ ও উৎপাদনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। জেলার বাকি ১৫ হাজারেরও বেশি কৃষকদেরও একই অবস্থা।

গত পাঁচ বছর ধরেই মেহেরপুরের বিএডিসির কাছ থেকে ধানবীজ নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন সদর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন। এবার আউশ মৌসুমে এক অভিনব কাণ্ড ঘটান তিনি। আগের মৌসুমে নিজের উৎপাদিত ধান থেকে কিছু বীজ রেখে দিয়েছিলেন তিনি। এবার দুই খন্ড জমিতে বীজতলা করেন। একখন্ডে বপন করেন নিজের তৈরি বীজ, আরেক খন্ডে বিএডিসি থেকে বিনামূল্যে পাওয়া প্রণোদনার বীজ।

শাহজামালের স্ত্রী কৃষাণী নাছরিন খাতুন জানান, গত দুই বছর ধরে প্রণোদনার বীজে অসংখ্য পোকা মিলছে। জমিতে বপন করার পর চারা গজাচ্ছে না। কৃষকেরাা প্রথমে একটি পাত্রের ওপর চারা গজাতে দিয়ে থাকে। সেখানে চারা না গজানই পুরো বীজ হাঁস মুরগী দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। একই কথা বলেন ওই গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন।

কৃষক শহজামাল জানান, এখন আর বিএডিসির বীজে কৃষকদের কোন অস্থা নেয়। কারণ বিএডিসির প্রণোদনা কিংবা বাজারে কেনা বীজেও প্রতারিত হচ্ছে হাজার হাজার কৃষক। এমনকি পচা বীজের কারণে একটি ফসল আবাদ করতে পারেননি অনেক কৃষক।

কৃষক আলমগীর হোসেন জানান, নিজের উৎপাদিত বীজে চারা গজিয়েছে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। আর বিএডিসির প্রণোদনায় পাওয়া বীজে চারা গজিয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ। তাহলে বিএডিসির বীজে আস্থা থাকবে কেমনে ? এজন্য বিএডিসির কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।

শুধু ধানবীজ নয়, বিএডিসি যে গম বীজ উৎপাদন করে সেটা নিয়েও মেহেরপুরের কৃষকদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে একটা হচ্ছে গমের বীজে বিভিন্ন জাতের মিশ্রণ, যা গমের ফলনই কমিয়ে দিচ্ছে। আর গমের জাতগুলোর বৈশিষ্টও হারিয়ে যাচ্ছে। বিএডিসি থেকে গমবীজ নিয়ে চাষ করার পর একই ক্ষেতে বিভিন্ন রকমের চারা বের হচ্ছে।

এদিকে, গম বীজে মিশ্রন থাকার অভিযোগে মেহেরপুর বিএডিসির কর্মকর্তাদের একবার কারণ দর্শাও নোটিশও দেয়া হয় ঢাকা অফিস থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, বারিগম-৩২ এ ১০ ভাগ মিশ্রণ পাওয়া গেছে, বারিগম-৩৩ এ যথেষ্ঠ মিশ্রণ রয়েছে আরবিডবিওএমআরআই-২ জাতটি সঠিকই হয়নি, এটি হবে বারিগম- ৩৩। অর্থাৎ বিডবিওএমআর-২ যে জাতটি কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার কথা থাকলেও সংগ্রহ করা হয়েছিলো বারি-৩০। সেটিই বিডবিওএমআরআই-২ জাত হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো বিএডিসির কর্মকর্তারা।

মেহেরপুর সদর উপজেলার কোলাগ্রামের কৃষক আব্বাস উদ্দীন মতেল জানান, গত মৌসুমে জমিতে প্রণোদনায় পাওয়া বিএডিসির গম বীজ দিয়ে আবাদ করেছিলোম। গুটি বাধার পর জমি থেকে একতলা, দুইতলা, তিনতলা এমনকি চারতলা পর্যন্ত গাছ পাওয়া যায়। অর্থাৎ একই জমিতে নানা জাতের গম উৎপাদন হয়েছে। এতে কমেছে গমের ফলন। গমবীজে প্রতি বছরই একই অবস্থা থাকলেও তাতে নজর নেয় বিএডিসির কর্মকর্তাদের। এ কারণেই বিএডিসির গম বীজে কিনতে চাচ্ছেন না কৃষকেরা। বাজারে বেসরকারী উৎপাদিত বীজে আস্থা রাখছেন কৃষকেরা।

একই গ্রামের কৃষক লিটন আলী জানান, বিএডিসির প্রণোদনা গমবীজেও সর্বশান্ত হয়েছে কৃষকেরা। আমি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বাজারে বেসরকারী বীজের চাইতে বিএডিসির গমবীজে ৪ থেকে ৫ মণ ফলন কম হচ্ছে। আবার কৃষকদের এসব বীজ থেকেই গমবীজ সংগ্রহ করবে বিএডিসি। এতে বছরের পর বছর বীজে মিশ্রণ বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকেরা। যেন দেখার কেউ নেয়?

বিএডিসির পচা বীজ নিয়ে এবার মুখোমুখি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বেলাল হোসেনের। তিনি জানান, এভাবে বিএডিসি নিম্নমানের বীজ উৎপাদন করতে থাকলে তার প্রভাব পড়বে শষ্য উপাদনে। দেশে তৈরি হবে চরম খাদ্য নিরপত্তার ঝুঁকি। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বীজ উৎপাদন করতে গিয়ে বিভিন্ন ধাপ পার করার পর সেই বীজ যায় কৃষকদের হাতে। তাহলে এতোকিছুর পরও নিম্নমানের বীজ কিভাবে যাচ্ছে কৃষকদের হাতে ? এমন প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

এবার সমস্ত তথ্য প্রমাণ নিয়ে মুখোমুখি মেহেরপুর বিএডিসির বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের উপ-পরিচালক শামীম হায়দারের। স্বীকার করেন গমের মিশ্রণ ও জাত পরিবর্তনের কারণে ঢাকা থেকে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশের। এজন্য ঊর্ধ্বতনর্ধ্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

তিনি আরও জানান, কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করা হয়েছে এ ধরনের ভুল আর আগামীতে হবে না। আর ধানবীজের বিষয়ে তিনি জানান, ধানবীজে পোকা থাকতেই পারে। এজন্য বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে বীজের পোকা মারার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও সমস্যা হয়েছে। বেশিদিন ঘরে বীজ পড়ে থাকায় এ সমস্যা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ