বর্তমান সমাজে অপরাধের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সাথে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশ বেড়ে চলছে। একসময় যে সমাজগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ, সেগুলোর আজকের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। অপরাধের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষের মনে ভয় এবং উদ্বেগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, শহরাঞ্চলে অপরাধের মাত্রা বেশি দেখা যাচ্ছে, যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, বাজার, রাস্তা বা বাসাবাড়ি—প্রতিটি জায়গাতেই এখন নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধীরা যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় হানা দিতে পারে, এমন ধারণা মানুষকে আরো অসন্তুষ্ট এবং উদ্বিগ্ন করে তুলছে। যেহেতু প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটেছে, অপরাধীরা তাদের কার্যক্রমও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালনা করছে, তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে।
অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণগুলো বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রথমত, সামাজিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের কারণে অনেক মানুষ অপরাধের দিকে ঝুঁকছেন। যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধা আসে, তখন তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। এছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, মাদকাসক্তি এবং পারিবারিক অশান্তির মতো কারণগুলোও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। মানুষ যখন মানসিকভাবে অসন্তুষ্ট থাকে, তখন তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবকাঠামো এবং কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি না থাকার কারণে অপরাধীরা সহজে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। যেসব এলাকায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথভাবে কাজ করে না, সেসব এলাকায় অপরাধের হার বেশি হয়। এমনকি, কিছু সময় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতি এবং অবহেলা লক্ষ্য করা যায়, যা তাদের কার্যক্রমকে দুর্বল করে তোলে।
তৃতীয়ত, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। যখন মানুষ অপরাধের প্রতিকার বা তার ফলাফল সম্পর্কে সচেতন থাকে না, তখন তারা অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো গেলে এর হার অনেকটা কমানো সম্ভব। তবে, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ এবং নিয়ম-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, অপরাধ বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। ডিজিটাল যুগে অপরাধীরা প্রযুক্তির সাহায্যে নানা ধরনের অপরাধ সংগঠন করতে সক্ষম হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ, মুঠোফোনের মাধ্যমে ফোন জালিয়াতি, এবং বিভিন্ন ধরণের অনলাইন প্রতারণা আজকাল সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। তাই, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এপর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে স্পষ্ট যে, অপরাধীরা শুধু রাস্তাঘাটে বা জনসমক্ষে অপরাধ করছে না, বরং তারা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও হস্তক্ষেপ করছে। বাড়িতে ঢুকে চুরির ঘটনা, ধর্ষণ, মারধর, অপহরণ এবং এমনকি হত্যার মতো নৃশংস অপরাধের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অপরাধের ফলে সাধারণ মানুষ ভয়াবহভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দিনের বেলা ঘর থেকে বের হওয়া, কিংবা রাতের অন্ধকারে একা বাড়ির বাইরে যাওয়া এখন অনেক মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপত্তাহীনতার এই পরিস্থিতিতে, সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র, সরকার, পুলিশ বাহিনী এবং নাগরিক সমাজ—এদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। পুলিশের কার্যক্রম আরো কার্যকর এবং জনমুখী করতে হবে। জনগণের প্রতি পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা জনগণের মাঝে আস্থার সৃষ্টি করতে পারে। এর পাশাপাশি, সমাজের অন্যান্য স্তর যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠনগুলোকে অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ অপরিহার্য। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার বাস্তবায়নেও নজর দেয়া উচিত। যে কোনো অপরাধীর দ্রুত বিচার এবং শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে অন্যরা সতর্ক থাকে এবং অপরাধের দিকে ধাবিত না হয়। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা অপরাধের শিকার হওয়ার আগে সতর্ক হতে পারে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারে।
নিরাপত্তাহীনতার সমস্যাটি একেবারে কমানোর লক্ষ্যে, নাগরিকদেরকে আইন অনুসরণ এবং অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে উৎসাহিত করতে হবে। অপরাধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধুমাত্র পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকেই একযোগে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে, তবেই অপরাধ কমানো সম্ভব।
অপরাধের এই বৃদ্ধি ও নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়, তবে এর সমাধান সম্ভব। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যেখানে সরকারের সঙ্গে জনগণের সহযোগিতা এবং সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।