Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো তথ্য

নৃশংসতম একুশে আগস্ট

ফিরোজ মান্না

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাসায় উপস্থিত পরিবারের সকল সদস্যসহ নির্মমভাবে খুন হওয়ার প্রায় তিনমাস আগে, ২১ মে বাসায় ফেরার পথে গ্রেনেড হামলার শিকার হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই হামলায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন তার দুই সঙ্গী। সরকারের কড়া নির্দেশনার কারনে তখন ঘটনাটি নিয়ে কোন খবর প্রকাশিত হয়নি।

তবে ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ঘটনাটি জানতে পারে ও রাষ্ট্রদূত ডেভিস বোস্টার ২৩ মে, এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনে একটি গোপন তারবার্তা পাঠান। একই সময়ে সেই বার্তা কলকাতা ও দিল্লীতে আমেরিকান দূতাবাসের অফিসেও পাঠানো হয়। বোস্টার হামলাকারীদের পরিচয় ও হামলার স্থান সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি। বিষয়টি প্রথম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১৩ই এপ্রিল, ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের দি ডেইলি স্টার পত্রিকায়।

১৯৭৫ সালে ২৩ শে মে তারবার্তায় বলা হয়,‘আমাদের কাছে দুইটি সূত্র মারফত খবর আছে, ২১শে মে রাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার উদ্দেশে হামলা হয়েছিল। ঢাকার বাইরে একটি টিভি স্টেশন পরিদর্শন শেষে মুজিব যখন তার বাসায় ফিরছিলেন, তখন হামলাটি করা হয়।’ দুটি সূত্রই নিশ্চিত করেছিল যে, এটি গ্রেনেড হামলা ছিল। এই খবরের প্রাথমিক সূত্র হিসেবে বোস্টার দূতাবাসের এক বাঙালি কর্মকর্তার কথা বলেন যিনি সেখানে রাজনৈতিক সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তারবার্তায় হামলার স্থান, টিভি স্টেশনটি কোথায় বা বঙ্গবন্ধুর সাথে কারা কারা ছিল তা নিয়ে কোন তথ্য নেই। সেই কর্মকর্তাকে এ ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছিল রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিভাগের একজন উপ-পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট। দ্বিতীয় সূত্রটি ছিল বাংলাদেশি একজন সাংবাদিক, যার নাম তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়নি। তিনি দূতাবাসের তথ্য কর্মকর্তাকে বলেন যে, গ্রেনেড হামলায় মুজিব অক্ষত থাকলেও দুইজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি আহত হন। তিনি আরো বলেনঃ “এই খবরটি ছাপানর ব্যাপারে পিআইডি থেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল।’

অভ্যুত্থানের প্রাথমিক তথ্য
পনের আগস্ট ভোরে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ধানমন্ডির বাড়িতেও হামলা চালায় সেনা সদস্যরা; খুন করে মনি ও তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু মনিকে। আর মিন্টু রোডে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা এবং তার দুই সন্তানসহ মোট চারজনকে হত্যা করে ঘাতকরা। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম এই সেনা অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া খুনিদের অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগস্থ ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং কারফিউ ঘোষণা করে। বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীকে বলা হয় সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে। রাষ্ট্রদূত বোস্টার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠান দুপুর ১ টা ২০ মিনিটে। তিনি জানান যে, ঢাকার সেনানিবাস ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশেপাশে বিপুল পরিমান ট্যাংক অবস্থান করছিল। তবে দূতাবাসের উপর হামলার কোন ঝুঁকি ছিল না।

সিআইএ’র পাওয়া তথ্য
১৫ আগস্ট সিআইএ তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে জানায় যে, ‘বাংলাদেশের পশ্চিমাপন্থী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্টপতি ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ মুজিবের পরিণতি জানা যায়নি; কেউ বলছে গৃহবন্দী, কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার দুই ভাগনে ও প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকেও হত্যা করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মার্শাল ল ঘোষণা করা হয়েছে, বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’ অভ্যুত্থান কেন হলো বা নতুন সরকারের আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে ততক্ষণ পর্যন্ত সিআইএ’র কাছে স্পষ্ট তথ্য ছিলনা। “তবে আশার কথা এই যে, শেখ মুজিবের মন্ত্রীপরিষদে মোশতাকই সবচেয়ে বেশি পশ্চিমাঘেঁষা এবং দলের মধ্যে একটি মধ্যপন্থার ছোট দলের সে ছিল পৃষ্ঠপোষক।’ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মোশতাক হয়তো দলের ডানপন্থীদের কাছে টানবে, যারা শেখ মুজিবের স্বেচ্ছাচার এবং ভারত-রাশিয়া নীতি ও বামপন্থার বিরোধী ছিল। যদিও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে খুব কম লোকেরই কথা বলার সাহস ছিল, তথাপি অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে কার্যকর ভূমিকা নিতে না পারায় চাপা অসন্তোষ ছিল চরমে। সিআইএ’র মতে ভারত এখন নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। যদিও ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার একটা অভিযোগ আগে থেকেই ছিল, তথাপি আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি না হলে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেনা।’ – চলবে

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ