Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড : ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারের গোপন বার্তা

নৃশংসতম একুশে আগস্ট

ফিরোজ মান্না

বঙ্গবন্ধু হত্যা কান্ড নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারের মতে, ওসমানী বর্ষীয়ান বা সাবেক মন্ত্রী না হলে মোশতাক হয়তো তাকে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পদ দিতো। প্রটোকলবিহীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা পদ দেয়ার মাধ্যমে এখন থেকে মোশতাক তাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে পারবে। এখন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে ওসমানী হয়তো আপাতত প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।

বোস্টার বলেন, পনেরই আগস্ট শেখ মুজিবকে উৎখাতের পর খুনীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার আস্থাভাজন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে দেয়া। সেনাবাহিনীতে তাকে একজন অপেক্ষাকৃত দূর্বল নেতা হিসেবে দেখা হতো। এই সুযোগে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যার ফলে কয়েকজন মেজর অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো সুযোগ পায়। অবশ্য কয়েকজন বিশ্লেষক রাষ্ট্রদূতকে বলেন রদবদলের পর সেনাবাহিনী এখন অভ্যুত্থানকারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

আমেরিকার স্বীকৃতি পেতে রাষ্ট্রদূতকে ডেকে অনুনয় করে মোশতাক

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আমেরিকার দ্বারস্থ হয় খন্দকার মোশতাক। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ এড়াতে আমেরিকাকে ব্যবহার করা। এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিক্সন সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার জন্য কলকাতায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে মোশতাক উপস্থিত ছিল। সেই সমঝোতা ব্যর্থ হয়।

১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘এবার আর সুযোগ না হারানোর’ পরামর্শ দেয় মোশতাক। সে বলে পরিস্থিতি এতোই জটিল যে ‘এক্ষুণি, আজকেই’ স্বীকৃতি প্রয়োজন। বৈঠকে স্বীকৃতির ব্যাপারে স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত না জানালেও অর্থনৈতিক সহযোগীতামূলক কর্মকান্ড স্বাভাবিকভাবেই চলবে বলে মোশতাককে আস্বস্ত করে বোস্টার। একই দিনে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে মত দেয়। বলেন, মোশতাক যখন নিজে থেকেই আমেরিকার সাহায্য চাইছে। এই অবস্থায় স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের পছন্দমতো পরিবর্তন আনতে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া ইংল্যান্ড, জাপান, বার্মাসহ আরো অনেকেই ইতিমধ্যে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে বোস্টারের মতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস কনফারেন্স করে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমেরিকা প্রস্তুত থাকলেও আরো কয়েকদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। মোশতাক জানায় আমেরিকার ফোর্ড সরকারের কাছ থেকে কি সহযোগীতা চাওয়া যেতে পারে তা সে তখনো ভাবেনি। কিন্তু আমেরিকার সরকারের কাছ থেকে তার স্বীকৃতি পাওয়াটা খুব জরুরি। এই স্বীকৃতি এদেশে ভারতের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে বলে সে জানায়। তার সন্দেহের কারন ছিল মুজিব-ইন্দিরার সখ্যতা, ভারতের মিডিয়াতে মোশতাকবিরোধী প্রচার ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শরনার্থী শিবিরে বাংলাদেশীদের জড়ো করার চেষ্টা ইত্যাদি।

আমেরিকার কাছে অস্ত্র চেয়েছিল জিয়া-ফারুক-রশীদ

রাষ্ট্রদূতের সাথে সেই বৈঠকে (২০ আগস্ট) মোশতাক মূলত স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করে, এবং এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে। এছাড়া সম্ভাব্য আর কি কি ধরণের সহযোগীতা প্রয়োজন সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। কিন্তু তার কিছুদিন পর নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ফারুক ও মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদ আমেরিকান দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শকের সাথে সাক্ষাত করে সরাসরি সামরিক সহায়তা চায়। উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের সম্ভাব্য আক্রমন ঠেকানোর কথা বলা হয়।

ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন বার্তায় বোস্টার বলেন, ফারুক ও রশীদ ২১ অক্টোবর দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শকের সাথে তার বাসায় সাক্ষাত করে আমেরিকার সামরিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করে। তারা জানায় মোশতাকই তাদের পাঠিয়েছে। এর আগে জিয়া বোস্টারের কাছে একই ধরণের সাহায্যের জন্য আবেদন করে। তবে বোস্টার তখন তাকে নিরাশ করেন। ফারুক-রশীদের মতে, ভারত অবশ্যই বাংলাদেশ আক্রমণ করে মোশতাক সরকারকে উৎখাত করতে চাইবে এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই। তবে ভারত সরাসরি আক্রমণ না করলেও এদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে মদদ দিতে চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া সোভিয়েত রাশিয়াও মোশতাক সরকারের জন্য হুমকি বলে তারা জানায়। তারা বলে, পাকিস্তান ও চীন থেকে যে সাহায্য পাওয়া যাবে তা দিয়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব না। সেক্ষেত্রে আমেরিকা সরাসরি বা তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে সামরিক সরঞ্জাম দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করে খুনীরা। বোস্টার লেখেন, অস্ত্র নয়, তারা চায় হেলিকপ্টার ও স্থলপথের যানবাহন যা দিয়ে দেশীয় বিভিন্ন সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করা সম্ভব। মেজরদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দূতাবাসের কর্মকর্তা তাদের বলেন এটা তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়েনা। তিনি তাদেরকে পরামর্শ দেন তারা যেন ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে। এই প্রস্তাবে মেজররা হতাশ হয়, কেননা তাদের ধারণা ছিল লিখিতভাবে অনুরোধ করলে আমেরিকান সরকার সেই আবেদন খারিজ করে দিতে পারে। তবে দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেন তার ধারণা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আমেরিকান সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।মেজররা তখন জোর দিয়ে বলে যে, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক অগ্রগতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সেই মুহুর্তে সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলাই মূখ্য উদ্দেশ্য। নিজের পর্যবেক্ষণে বোস্টার জানান, ভারতীয়রা সে মুহুর্তে কি করছে তা তার জানা নেই, তবে বাংলাদেশ সরকার কি ভাবছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন ওয়াশিংটনের উচিত মেজরদের অনুরোধকে আমলে নেয়া।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় আমেরিকার হাত ছিল, দৃঢ় বিশ্বাস অনেকেরই

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সাথে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের যোগাযোগ এবং ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন বার্তায় মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা, বাকশাল কায়েমের পর মুজিবকে স্বৈরাচার ও জনবিচ্ছিন্ন নেতা বলা এবং তাকে হত্যার পর বেশি আন্তরিক ও পশিমাঘেঁষা মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়া ইত্যাদি কারনে অনেকেরই ধারণা আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবই জানতো, কিন্তু তা প্রতিহত করতে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

একবার তো শেখ হাসিনা রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করেই বসেন যে তাদের সরকার কোন কারনে তাকে বা তার দলকে অপছন্দ করে কিনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে তার দলের অনেক নেতাই মনে করেন আমেরিকা তাকে বা তার দলকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার ঘোর বিরোধী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ