মিথুন আশরাফ – আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ৮৭ বছর বয়সে রবিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতাকে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত প্রাণ সাজেদা চৌধুরী চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক নেতাসহ সর্বস্তরের জনগণ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকলেই শোক জানিয়েছেন। সোমবার বেলা ১১টায় তার নির্বাচনী এলাকা নগরকান্দার এম এন একাডেমি স্কুল মাঠে তার জানাজা হয়। বিকাল ৩টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয় সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। আসরের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আরেক দফা জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
উচ্চরক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে আগস্টের শেষের দিকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি হন তিনি। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের এই কান্ডারী দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাজেদা চৌধুরী জাতীয় সংসদের উপনেতা হন।
তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সাথে জড়িত থেকে নারীরা রাজনীতি করেছেন, তাদের মধ্যে শেষ নারী হিসেবে জীবিত ছিলেন সাজেদা চৌধুরী। তিনিও মারা গেলেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাজেদা চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি সুদৃঢ় রাখতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জাতি শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করবে। দেশের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও আপসহীন নেতৃত্ব জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো।
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের এই কাণ্ডারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ উপনেতা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী ছিলেন ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তরুণ বয়সেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সাজেদা ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরার পর তার সঙ্গেও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সাজেদা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১০ সালে সাজেদা চৌধুরীকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে সরকার।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশ এমন একজন রাজনীতিককে হারালো, যিনি পুরোটা জীবন আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সংকটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে দশ বছর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
ফরিদপুর-২ আসন থেকে চার বার নির্বাচিত হয়ে ২০০৯ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনবার জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশ গঠনে প্রত্যন্ত এলাকার জনমানুষের নেতা হিসেবেও বড় ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৭৪ সালে তিনি গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো ফেলোশিপ প্রাপ্ত হন। ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট তাকে বর্ষসেরা নারী (উম্যান অভ দ্য ইয়ার) নির্বাচন করে। সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী সাজেদা চৌধুরী ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
একজন মেধাবী, দেশপ্রেমিক ও আপসহীন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছিলেন সাজেদা চৌধুরী। তার অবদান জাতি কোনোদিন ভুলবে না। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন এ মহান মানুষটি। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বগুণ ও নির্মোহ ব্যক্তিত্ব চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠনে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। তার অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কোর ফেলোশিপপ্রাপ্ত হন। তিনি গার্ল-গাইড এসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পদক ‘সিলভার এলিফ্যান্ট’ অর্জন করেছিলেন।
সাজেদা চৌধুরী দুর্দিনে আওয়ামী লীগের পাশে থেকে দলকে সংগঠিত করেছেন। তিনি শুধু আওয়ামী লীগের কাছেই নয়, তিনি সব মানুষের কাছে ছিলেন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিক হিসেবেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার কমতি ছিল না। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক নেতা।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ ও মা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী সাজেদা চৌধুরীর স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালে মারা গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভরসা আর আস্থার স্থান।
১৯৫৬ সাল থেকে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। ১৯৬৯-১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক, ১৯৭২-১৯৭৬ সময়কালে বাংলাদেশ গার্ল গাইডের ন্যাশনাল কমিশনার এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়কের দায়িত্বও তিনি পালন করছেন।
তিনি ফরিদপুরের কৃষাণপুর ইউনিয়ন (ফরিদপুর-২; নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুর) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এ অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হন।