স্টাফ রিপোর্টার – বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বাংলাদেশের স্থলভাগে এসে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এরপর এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের আসামের দিকে চলে গেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। তবে ‘সিত্রাং’য়ের আঘাতে অন্তত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। জীবন কেড়ে নিয়ে চলে গেছে সিত্রাং। জনদুর্ভোগে আছে দেশ। এরমধ্যে মিরসরাইয়ে ড্রেজার ডুবেই ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ বাংলাদেশের স্থলভাগে এসে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এরপর এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের আসামের দিকে চলে গেছে। এটি ক্রামান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে।
তিনি জানান, এরই মধ্যে বাংলাদেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি হতে শুরু করেছে। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের বৃষ্টি থেমে গেছে। বিভিন্ন স্থানে দু’দিন পর রোদের দেখা মিলেছে। বজলুর রশিদ আরও জানান, সোমবার মধ্যরাতে উপকূল অতিক্রমরত ঘূর্ণিঝড় “সিত্রাং’ আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অতি দ্রুত অগ্রসর হয়ে ভোলার পাশ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে। এটি উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি ঝরিয়ে দ্রুত দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে এবং ওই সময় এটি স্থল নিম্নচাপ আকারে ঢাকা-কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল। পরে ‘সিত্রাং’ স্থল নিম্নচাপ আকারে ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপর দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম কর ভারতের আসামের দিকে চলে গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাবে রবিবার থেকেই দেশের আবহায়া পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়। সেই বৃষ্টি চলে সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত। রংপুর বিভাগ ছাড়া মোটামুটি সারাদেশেই হালকা ও মাঝারি ধরনের এবং ভারি বৃষ্টি হয়, কোথাও কোথাও অতিভারি বৃষ্টিও হয়। রবিবার দিবাগত রাতে ঢাকায় হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। সোমবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বৃষ্টির মাত্রা। সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয় ঢাকায়।
রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সোমবার সকালে ঢাকার আকাশ মেঘলা থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে কেটে যায় মেঘ। দু’দিন পরে ঢাকায় রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এখনও অমাবশ্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুটের বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
মোংলা, পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরসমূহকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
সিত্রাংয়ের আঘাতে মোংলায় দুদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে লাখো মানুষ। দুদিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন মোংলা বন্দর ও পৌর শহরসহ গ্রামাঞ্চল। গত শনিবার রাতের হালকা বাতাস ও বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর রবিবার দুপুরে স্বল্প সময়ের জন্য কয়েক দফায় এলেও বিকেল থেকে ফের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম বিপাকে পড়ে এলাকাবাসী। রবিবার সন্ধ্যা থেকে মোবাইল নেটওয়ার্কেও দেখা দিয়েছে জটিলতা।
সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে মোংলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। ঝড়ে সোমবার রাতে পশুর নদীর লাউডোব এলাকায় সিমেন্টের কাঁচামাল (জিপসাম) এমভি পৌষ-ফাল্গুনের পালা কার্গো জাহাজ ও বঙ্গবন্ধু মোংলা-ঘাষিয়াখালী আন্তর্জাতিক চ্যানেলে ডুবে গেছে বিআইডব্লিটিসির স্টিমার ঘাটের পল্টুন। ডুবন্ত দুইটি নৌযান মার্কিং করে সতর্ক লাল নিশানা টানিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আট জেলায় ১২ জনের প্রাণ কেড়ে নিল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এ ছাড়া উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ঢাকা, নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল ও কক্সবাজারসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ৬-৯ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ঢাকায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে রাজধানীর হাজারীবাগে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। একটি বহুতল ভবনের ছাদের রেলিং ধসে পাশের সড়কে পড়ে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ৮টার দিকে হাজারীবাগ মসজিদের পাশে একটি ভবনের ছাদের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে যায়। এতে নিচে থাকা এক রিকশাচালক আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
কুমিল্লায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল এলাকায় রাত ১০টার দিকে গাছচাপা পড়ে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। এরা হলেন – হেসাখাল খামারপাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন (২৮), তার স্ত্রী সাথী আক্তার (২৪) এবং তাদের ৪ বছরের শিশু সন্তান লিজা।
সিরাজগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে উত্তাল যমুনা নদীতে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। রাত ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদের পূর্ব মোহনপুরে যমুনা নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নৌকাটিতে ৫ জন আরোহী ছিলেন। তিনজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও মা ও ছেলের মৃত্যু হয়।
ভোলায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নে গাছচাপা পড়ে মনির স্বর্ণকার (৩৫) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মনির সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল দিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের প্রভাবে গাছচাপা পড়ে গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে ভোলার দৌলতখান পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরচাপা পড়ে বিবি খাদিজা (৮০) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে।
বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে গাছচাপায় রাত ৮টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় আমেনা খাতুন নামে শতবর্ষী এক বৃদ্ধা মারা গেছেন। মৃতের স্বজনরা জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে বসে ভাত খাচ্ছিলেন আমেনা খাতুন। এ সময় ঘরের পাশে থাকা একটি চাম্বল গাছ উপড়ে তার ঘরের ওপর পড়ে। এতে ঘরের নিচে চাপা পড়েন তিনি। পরে স্বজনরা তাকে মৃত অবস্থায় ঘরের নিচ থেকে উদ্ধার করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর প্রভাবে স্থলসীমা অতিক্রম করার সময় কসবা গোপীনাথপুরে ঘরে গাছচাপায় জয়নাল আবেদিন (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন তার স্ত্রীও। সোমবার রাত ১টার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় গাছচাপায় তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।
পটুয়াখালীতে সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নে প্রতাপপুর লঞ্চঘটে একটু দূরে নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় মিজানুর রহমান (৪০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৯টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার সকালে অভিযান চালিয়ে ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও নড়াইল ও শরীয়তপুরে আরও দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে মিরসরাইয়ে সমুদ্রে ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে।