রুপম আক্তার: গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার চাহিদা ও দাম কমার কারণে এ বছর থেকে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারন করে দেয় সরকার। এ বছর কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানি পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার বর্গফুটপ্রতি দাম গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ ৫ টাকা, আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বাড়ানো হয়। রাজধানীতে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাক। আর ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। গত বছরের তুলনায় এ বছর চামড়ার দাম কিছুটা বাড়লেও গত এক দশকে দেশের কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ক্রমান্বয়ে কমেছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, এবারের ঈদুল আজহায় সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪ লাখের বেশি পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৫০ হাজারের মতো গরু-মহিষ এবং বাকিগুলো খাসি, বকরি, ভেড়াসহ অন্যান্য পশু। গত বছর ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। সরকার লবনযুক্ত চামড়ার দাম বাড়ানোর ফলে কিছুটা লাভবান হবেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মি. খান বলেন, ‘গত বছর আমরা চামড়া কিনেছি ১ লাখ ১৮ হাজার পিস। এবার আমাদের ১ লাখের পিসের বেশি কেনা যাবে না বলেই মনে হচ্ছে’।
পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘চলতি বছর চামড়ার সরবরাহ ভালো। আমরা পোস্তার ব্যবসায়ীরা ১ লাখ ৬০ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছিলাম। আশা করছি, সেই পরিমাণ চামড়া কিনতে পারব।’
কোরবানির পশুর এই চামড়া অনেকেই দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা কিংবা এতিমখানায় দান করেন। এই চামড়ার টাকা দিয়ে এতিম শিশুদের ভরণ পোষণও চলে। চামড়া সঠিক দামে বিক্রি করতে না পারলে দুশ্চিন্তায় পড়েন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেশি ছিল। সেবার গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। এরপর থেকে বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গরুর চামড়ার দাম কমতে শুরু করে ২০১৪ সালে। এ বছর চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০-৭৫ টাকা নির্ধারণ করে। যদিও বাস্তবে আরো বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল। এবছর পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়া বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়। এরপর থেকে চামড়ার দাম কমতে শুরু করে। ২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর কমেছে। গত বছরও একই দশা ছিল। রাজধানীসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সড়কে ফেলে দেয় এবং কেউবা মাটিতে পুঁতে ফেলে।
ক্রমান্বয়ে চামড়ার দাম কেন কমছে এ বিষয়ে পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, ‘কাঁচা চামড়ার কম মূল্যের পেছনে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট দায়ী। পাশাপাশি চামড়া শিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যাও বড় কারণ। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের চামড়া শিল্প পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে পারেনি। যে কারণে ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ মিলছে না। ফলে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রফতানি করতে হচ্ছে।’
জানা যায়, চামড়া শিল্পে দূষণের এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। দূষণ কমাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নেতৃত্বে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগরী, যার মধ্যে ৫২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেয়া হলেও পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা যায়নি। কারণ বিপুল অর্থ ব্যয় করে দুই বছরের বদলে নয় বছর সময় নিয়ে নির্মিত সিইটিপি চামড়া শিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরাতে ২০০৩ সালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প হাতে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। মোট ১২ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় এ শিল্পনগরী। ২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর হয় ট্যানারি শিল্প। কিন্তু তখনো শেষ হয়নি সেন্ট্রাল অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের (সিইটিপি) কাজ। ফলে সিইটিপি ছাড়াই কাজ শুরু করে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। এবার ট্যানারির দূষিত পানি মিশতে থাকে ধলেশ্বরী নদীতে। নতুন শিল্পনগরীও আগের মতোই দূষণ ছড়াতে থাকে। সব মিলিয়ে এত বিনিয়োগের পরও চামড়া শিল্পের সফল ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি এ নগরী। এমনকি সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ব্যবসায়ীদের বিপুল বিনিয়োগও কাজে লাগেনি। উল্টো পরিবেশ দূষণের দায়ে এসব ট্যানারি বন্ধ করে দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছে।
চামড়া শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় ক্রমান্বয়ে রফতানি আয় হারাচ্ছে দেশ। চামড়া শিল্পের বাজার সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইজিএম) সহযোগী অধ্যাপক ড. মূহ. আব্দুর রহীম খান বলেন, ‘চামড়া শিল্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজার ছিল ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে প্রসারিত হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে ৭৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের মোট গবাদি পশুর ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশের আবাসস্থল বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এ করুণ ও ভগ্নদশার পেছনের কারণগুলোকে সক্রিয় বিবেচনায় আনতে হবে।’ বিআইজিএমের এ সহযোগী অধ্যাপক জানান, শুধু চামড়াই নয়, এসব পশুর হাড় বা অস্থিগুলো রূপান্তরের মাধ্যমে উপজাত (বাই-প্রডাক্ট) হিসেবে রফতানি বাজার দখল করে নিতে পারে। এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি পুরোটাই নেতিবাচক। ২০১৫ সালে এর বাজার ছিল ২৯৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪ মিলিয়ন ডলারে। হ্রাসের এ ধারা অব্যাহত আছে।