ডিসেম্বরে ৫০৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরেছে ৫৩৯ প্রাণ

স্টাফ রিপোর্টার: ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সারাদেশে ৫০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৩৯ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৪ জন। নিহতদের মধ্যে ৭৯ জন নারী ও শিশু ৭৭ জন।

এ ছাড়াও ২১১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২০৬ জন, যা মোট নিহতের ৩৮.২১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪১.৮৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হয়েছেন ১১৪ জন, যা মোট নিহতের ২১.১৫ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭২ জন, অর্থাৎ ১৩.৩৫ শতাংশ। এই সময়ে ৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। ১৯টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়েছেন।

শনিবার (৪ জানুয়ারি) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং সংস্থাটির নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
সড়ক দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২০৬ জন (৩৮.২১ শতাংশ), বাসযাত্রী ২১ জন (৩.৮৯ শতাংশ), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৩০ জন (৫.৫৬ শতাংশ), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস আরোহী ৩২ জন (৫.৯৩ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু) ১১২ জন (২০.৭৭ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-আলমসাধু-টমটম-লাটাহাম্বা) ১৫ জন (২.৭৮ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ৯ জন (১.৬৬ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৯৩টি (৩৮.২৯ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ২১৪টি (৪২.৪৬ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৫৫টি (১০.৯১ শতাংশ) গ্রামীন সড়কে, ৩৮টি (৭.৫৩ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং ৪টি (০.৭৯ শতাংশ) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯৮টি (১৯.৪৪ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৪৭টি (৪৯ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১৬টি (২৩ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৩৫টি (৬.৯৪ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৮টি (১.৫৮ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ডাম্পার-সেনা বাহিনীর ভ্যান ২৯.৫৯ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৭৭ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৪.৯৭ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৭.৯৩ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা) ১৭.৩৪ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্রা) ৪.০৮ শতাংশ, বাইসাইকেল-রিকশা ১.৪০ শতাংশ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ০.৮৯ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৮৪টি। (বাস ১০৮, ট্রাক ১৫৩, কাভার্ডভ্যান ২১, পিকআপ ২৪, ট্রাক্টর ১০, ট্রলি ১১, লরি ৯, ডাম্পার ৩, সেনাবাহিনীর ভ্যান ১, মাইক্রোবাস ১১, প্রাইভেটকার ২৩, অ্যাম্বুলেন্স ৩, জিপ ২, মোটরসাইকেল ২১৯, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-লেগুনা) ১৩৬, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র) ৩২, বাইসাইকেল-রিকশা ১১ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ৭টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে ভোরে ঘটেছে ৪.৭৬ শতাংশ, সকালে ৩১.৯৪ শতাংশ, দুপুরে ১৭.৬৫ শতাংশ, বিকালে ১৮.৬৫ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৭.৭৩ শতাংশ এবং রাতে ঘটেছে ১৯.২৪ শতাংশ।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, মোট দুর্ঘটনার ৩১.৩৪ শতাংশ ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, প্রাণহানি ৩২.৮৩ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৬৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১৬.৬৯ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.৪৬ শতাংশ, প্রাণহানি ১৭.০৬ শতাংশ; খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৫৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৬.৪৯ শতাংশ; বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৩৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৬.৬৭ শতাংশ; সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৯৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৪.৮২ শতাংশ; রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১২ শতাংশ, প্রাণহানি ৮.১৬ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৫৩ শতাংশ ও প্রাণহানি ৭.২৩ শতাংশ ঘটেছে।

ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৫৮টি দুর্ঘটনায় ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৩০টি দুর্ঘটনায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় ৪১টি দুর্ঘটনায় ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম বরগুনা, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড় জেলায়। এই ৩টি জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ৪২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়েছেন।

নিহতদের পেশাগত পরিচয়:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৩ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১২ জন, সাংবাদিক ৩ জন, প্রকৌশলী ২ জন, আইনজীবী ২ জন, উপ-সচিব ১ জন, কৃষি কর্মকর্তা ১ জন, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ১ জন, পবিপ্রবির উপ-পরিচালক ১ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৯ জন, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩ জন, ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৪ জন, স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ী ৩২ জন, ২ জন ইউপি সদস্যসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১১ জন, ইমাম-মুয়াজ্জিন ৪ জন, পোশাক শ্রমিক ৫ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৯ জন, রঙ মিস্ত্রি ৪ জন, ইটভাটা শ্রমিক ৩ জন, প্রতিবন্ধী ২ জন এবং বুয়েটের ১ জন ছাত্রসহ দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের ৬৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য:
গত বছরের নভেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬২ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ১৫.৪ জন। ডিসেম্বরে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ১৭.৩৮ জন। এই হিসেবে ডিসেম্বর মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ১২.৮৫ শতাংশ।

প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে— ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে।

সুপারিশ হিসেবে বলা হয়েছে— দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

সর্বশেষঃ