মুহম্মদ শফিকুর রহমান
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সুবহে সাদেক। “হাইয়ো আলাস সালাহ (নামাজের জন্যে জাগো ওঠে), হাইয়ো আলাস ফালাহ (মুক্তির অন্বেষায়ে জাগো ওঠো), আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম (নামাজ নিদ্রা থেকে উত্তম)”। সুবহান মসজিদের মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি ভোরের নির্মল বাতাসে মিসে এক অপূর্ব সুখকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলছিল। অনেকেই তখন মসজিদের দিকে দৌড়োচ্ছিলেন। কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের স্রষ্টা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে শোনা যাচ্ছিল মেশিন গানের বিকট শব্দ। মুয়াজ্জিনের আযানের সুললিত ধ্বনি যেমন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল তেমনি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হচ্ছিল বাংলার হৃদয়।
ওরা কারা? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু লোক। সংখ্যায় মাত্র দেড়শ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কামান গোলা বারুদ। একজন ট্যাংক চালাচ্ছিল, সামনে তাক করা মেশিন গান। পরে আবিষ্কার করা হল ট্যাংকে কোনো গোলাবারুদ ছিলনা। তার আগে বিদীর্নবক্ষ নিয়ে সিড়ির গোড়ায় লুটিয়ে পড়লেন স্বাধীন বাংলাদেশে খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতি, সংগীত, নাটক তথা সোনার বাংলার জন্যে সোনার ছেলে গড়ার সারথিদের আগে আগে চলা বীর মুক্তিযোদ্ধা অদম্য তারুন্য ক্যাপ্টেন শেখ কামাল। তারপর সিড়ির মাঝখানে বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রের পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লুটিয়ে পড়ার আগে জানতে চেয়েছিলেন কী চাষ তোরা? ওরা জবাব দিয়েছিল স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানের ব্যারেলে। তারপর একে একে বঙ্গবন্ধুর আমরন সহধর্মিনী-সহযোদ্ধা মহিয়সী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠপুত্র শিশু শেখ রাসেল। কামাল-জামালের সাথে তাদের নবপরিনীতা বধু, যাদের হাতে তখনো মেহেদীর রং। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসের। অন্য বাড়িতে ছাত্র-যুব সমাজের আইকন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যুব নেতৃত্ব শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তসত্তা সহধর্মিনী আরজুমনি, আবদুর রব সেরানিয়ারাত ও তাঁর ৪ বছরের নাতি শিশু সুকান্ত সেরানিয়ারাত। অথচ তখন বাঘা বাঘা জেনারেল ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। কেবল জীবন দিলেন কর্নেল জামিল।
৪৭ টি বছর চলে গেল। সেদিনের সেই রক্তধারা ৩২ নম্বরের সিড়ি বেয়ে গড়াতে গড়াতে বাংলার সবুজ মাঠ ঘাট চরাচর ধুয়ে মুছে পলি ছড়িয়ে চলেছে আজো। কী অসাধারন অপ্রতিরোধ্য। এই জলতরঙ্গ রুধিবে কে? পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে যেন একজন ডেকে বললে, পথিক তিষ্ট ক্ষনকাল। এখানে বাংলার হৃদয় ঘুমিয়ে আছে। একটু উষ্ণতা নিয়ে যাও পথিক, পথ হারাবেনা।
৪৭ বছরেও পথ হারায়নি বাঙালি। উর্দি পরা কতোগুলো লোক ভেবেছিল টুঙ্গিপাড়ার মত দক্ষিন বাংলার একটি পশ্চাদপদ এলাকায় রেখে এলে আর কোনোদিন কেউ মনে রাখবেনা। ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে মার্কিন থান কাপড়ের কাফন পরিয়ে মাত্র ১৪ জন লোক জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। উর্দি রং-এর হেলিকপ্টার দেখে মানুষ টুঙ্গিপাড়া ছেড়েছিল। তবু সাহস দেখিয়েছেন একজন ইমাম যিনি জানাজা পড়িয়েছিলেন। প্রথমে জানাজা না পড়েই মাটি চাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমাম সাহেব সরাসরি বললেন, উনি মুসলমান, জানাজা ছাড়া দাফন করতে পারবনা। মানুষ ভাবেন এক আল্লাহ ভাবেন আরেক। টুঙ্গিপাড়া আজ বাঙালির তীর্থভূমিতে পরিনত হয়েছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিককে বিনা বাক্য ব্যয়ে ঐ তীর্থভূমির কাছে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতে হবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির পাশে, দাঁড়াতে হবে টুঙ্গিপাড়ার সমাধিপাশে। বলতে হবে ক্ষমা কর রাসেল সোনা, নইলে যে আমাদের পাপ মোচন হবেনা।
বস্তুত স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত শুরু হয়। যে হেনরি কিসিঞ্জার (ইউএস পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চরম বিরোধীতাকারী) স্বাধীনতার পরপরই বলেছিলেন- “ঞযব বসধৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয রং ধহু ঢ়বৎংড়হধষ ফবভবধঃ”. (বাংলাদেশের অভ্যূদয় আমার ব্যক্তিগত পরাজয়)। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অপমান করেছিল এভাবে- ইধহমষধফবংয রং ধ রহঃবৎহধঃরড়হধষ ইধংশবঃপধংব. ১৯৭৩ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতাটি করেন তাতে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত- আমি শোষিতের পক্ষে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তথা কিসিঞ্জার বাহিনির এই বক্তব্য পছন্দ হয়নি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় আমার “গরীব দুঃখি মানুষ” কথাটি উচ্চারন করতেন। ঢাকার রেসকোর্স বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- “যে কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের শ্রমে ঘামে আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবৃত্ত হয়, আমার গায়ে কাপড় ওঠে, তাদের সম্মানের সাথে কথা বলতে হবে” বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ইজ্জত দিয়ে কথা কইয়েন। এসব দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের পছন্দ হয়নি।
তাছাড়া ১৫ আগস্টের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। আওয়ামী লীগের ৫ জন এমপিকে হত্যা করা হয়, এমনকি ফরিদপুরে ঈদের জমাতে ব্রাশ ফায়ার করে একজন এমপিকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন স্থানে পাটের গুদামে আগুন, ব্যাংক লুট এগুলো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। জাসদের গনবাহিনী, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিসহ বিভিন্ন আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টি এসব হত্যাকান্ড ঘটিয়ে চলে। যে কারনে একশনে নামে আর্মি এবং রক্ষীবাহিনী। এতে করে রাষ্ট্রবিরোধীরা অপপ্রচারের সুযোগ পায়। সে সময় যত আওয়ামী লীগ, সমমনা দল ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয় রক্ষীবাহিনীর হাতে মারা যায় তারচেয়ে অনেক কম। অথচ স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রচার করতে শুরু করে রক্ষীবাহিনীর হাতে ৩০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছে। যে অপপ্রচার বিএনপি এখনো করছে। সে সময় তিনটি পত্রিকা জাসদের দৈনিক গনকন্ঠ, ভাসানী ন্যাপের সাপ্তাহিক হক কথা, অলি আহাদের সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ যে ধরনের নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করেছে তা সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালায় পড়েনা। পরবর্তীতে এই পত্রিকা গোষ্ঠী বিএনপি জামাতের সাথে হাত মিলিয়ে এখনো অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
৭১এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, বিশেষকরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের আপনজন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরকারও বঙ্গবন্ধুকে সর্তক করেছিলেন। ইন্দিরা সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন সচিব ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঢাকায় দেখা করেন। অনেকের মতে তিনি তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সর্তক করে যান। এমনকি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুশওয়ান সিং এর পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘Elasteted weekly (দিল্লী থেকে প্রকাশিত এবং এ অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়) পত্রিকার ছোট্ট একটি সংবাদ প্রচারিত হয় ১৫ আগস্ট এর তিন দিন আগে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনে সতর্ক করে বলেছিলেন “Excellency Mr prime Minister something terrible may happen in your country” বঙ্গবন্ধু তাতেও বিশ্বাস করেননি বলেছিলেন ‘thank you madam prime minister of Great India, but don’t worry, they are all my children. বঙ্গবন্ধু যাদের children বললেন তারা মূলত ছিল বাঙালির অবৈধ সন্তান। তারা বঙ্গবন্ধুর বিরাট বক্ষের মমতাকে দাম দিলোনা। গুলি চালালো তার বুকে ঝাজরা করে দিল বুকটাকে।
পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে বহুবার হত্যা করতে চেয়েছে পারেনি। মিলিটারি স্বৈরাচার আয়ুব খাঁ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিল, পারেনি। জনগণ রাজপথে নেমে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনে। ঐ মামলা চলাকালে অপর আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিজের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করেন। একাত্তরের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দী করে এবং গোপনে সামারি ট্রায়াল করে দুইবার ফাঁসি দেবার চেষ্টা করে। যে কক্ষে তিনি বন্দী ছিলেন তার জানালার পাশে কবর খোঁড়া হয় মানসিক নির্যাতন চালাবার জন্য। সেখানেও হত্যা করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় বরণ পাকিদের কোমর ভেঙে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবে কি। ওদের ৯৩ হাজার মিলিটারি আমাদের কাছে বন্ধী হয়ে আছে। এমনকি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করলে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় ফিরে আসেন। পাকিস্তান যে প্লেনে বঙ্গবন্ধুকে তুলে দেয়া হয়েছিল জনশ্রুতি আছে ওই প্লেনেও একজন খুনিকে তুলে দেয়া হয়েছিল। ওই খুনিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পায়নি। হত্যা করলো কে, হত্যা করল বঙ্গবন্ধু যাদের মাই চিলড্রেন বললেন সেই মিলিটারি চিলড্রেন রা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে মিলিটারি জিয়া মোশতাক, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ ছাড়াও আরো কারা কারা জড়িত ছিল বা রাজনৈতিক শক্তি কারা তা উদঘাটন জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশনের দাবি দিনে দিনে জোড়ালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলাসহ গুলি বোমার হামলার ২০টি ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে সামনে এসেছে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভ্রমণরত প্লেনের ইঞ্জিনের নাট বল্টু খুলে রাখা হয়। আল্লাহর অশেষ কৃপায় দ্বিতীয় ইঞ্জিন ছিল প্লেনে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ১৩ টি গ্রেনেড হামলা হয়। এখানেও আল্লাহর রহমত যে ট্রাকের উপর শেখ হাসিনা বক্তৃতা করেছিলেন সে ট্রাকের নিচে একটি গ্রেনেড পড়েছিল ঠিকই তবে তা বিস্ফোরিত হয়নি। গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয় হাওয়া ভবনে। ঐ ট্রাকে নেত্রী ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। সবাই বেঁচে গেলেন তবে ঐ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত এবং তিন শতাধিক গ্রেনেডের স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়। তাদের অনেকেরই আজও গ্রেনেডের স্পিøন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন যন্ত্রনা বুকে ইন্তেকাল করেন। এমনকি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনেও দুইবার গুলি চালানো হয়।
মৃত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিরা ছাড়াও যে পেছনে রাজনৈতিক কুশীলব রয়েছে তার একটি উদাহরণ হল জনশ্রুতি আছে দেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক রয়টারসের আতিকুল আলম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ঘটার আগেই রয়টার্স এর মাধ্যমে প্রচার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে ঘটনা ঘটার আগে তিনি কি করে জানলেন? তারমানে তিনি পুরো প্ল্যান আগে থেকে জানতেন। এরকম কুশীলব আরো যে কত আছে সেজন্য উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আশার কথা হল আইন মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজতে কমিশনের রূপরেখা প্রস্তুত। শনিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছেন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেবার জন্য যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল কারা কারা জড়িত ছিল তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর উদ্দেশে এই কমিশন।
এবার সেই কালরাত এবং কিছু কথা। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও আমি দিনের ঘটনাবলী নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম কিন্তু আমার রিপোর্ট ছাপা হয়নি কারণ ঐ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশের দায়িত্বে অসংবাদিক উর্দী পড়া সাধারণ পোশাকের কিছু লোক কোন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল না। রাত একটায় শেষ রিপোর্ট জমা দিয়ে আমি বাসায় গিয়েছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসবেন। ক্যাম্পাস সাজানোসহ আয়োজনের সব দায়িত্ব ডাকসু, ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন সহ স্বাধীনতার পক্ষের সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের। ইত্তেফাকের নিউজ এন্ড এক্সিকিউটিভ এডিটর আসফ-উদ-দৌলা রেজা আমাদের রেজা ভাই আমাকে এসাইনমেন্ট দিলেন বঙ্গবন্ধুর ক্যাম্পাসে আগমনের আদ্যোপান্ত নিউজ করার জন্য। শুনেছি ঐদিন সংবর্ধনা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ ফেরত দেয়া হবে ১৯৭৩ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে ইউসিস (ইউনাইটেড স্টেট ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল সেন্টার)। তোপখানা রোড দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল নিয়ে যাবার সময় ইউসিসে আগুন ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। তাদের অভিযোগ ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন পুলিশ তাদের থামাতে ব্যর্থ হয়ে গুলি চালালে একজন মারা যায়। তখন বঙ্গবন্ধু সরকার যেহেতু ক্ষমতায় সেহেতু বঙ্গবন্ধু সরকারকে দায়ী করে ডাকসু থেকে বঙ্গবন্ধুর আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে। তৎকালীন ডাকসু ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বঙ্গবন্ধুর আজীবন সদস্য পদের কাগজপত্র ছিড়ে ফেলে।
অতঃপর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে জাতীয় রাজনৈতিক প্লাটফর্ম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাকশাল গঠনের পর ছাত্র ইউনিয়ন সিপিবিসহ নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে জাতীয় দলে যোগ দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকে ক্যাম্পাসে সংবর্ধনা প্রধান ও ডাকসুর সদস্যপদ পুনরায় প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৪ আগস্ট থেকে ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র সমিতি দিনভর ধূয়া মোছা ও সাজানোর কাজে লিপ্ত। আমি বেলা ১১:০০ টায় ক্যাম্পাসে যেয়ে সারাদিন ক্যাম্পাসে ছিলাম। মাঝে একবার কেবল জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে লাঞ্চ করি। শরীফের ক্যান্টিন আর মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দেই। রাত দশটায় ডাকসু ভবনের চত্বরে (তখন ভবন ছিল না) যাই। এ সময় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বাংলাদেশের স্পোর্টস কালচারের অন্যতম প্রাণপুরুষ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল কে দেখলাম বন্ধুদের নিয়ে সাজানো গোছানোর কাজ করতে। রাত ১১:৩০ টার দিকে কামাল ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন। অল্পক্ষনেই আবার ফিরে আসেন। এবার সাথে তার নবপরিণীতা বধু সুলতানা কামাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অ্যাথলেট। রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমি ক্যাম্পাস ত্যাগ করে অফিসে এসে আপডেট দিয়ে বাসায় চলে যাই এবং ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি এমন রক্তাক্ত ভোর জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ছোট চাচা ব্যাংকার আব্দুর রশিদ ও আমি নারিন্দা একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। স্বাভাবিক নিয়মে চাচা সুবহে সাদেকে ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে রেডিওর নব ঘুরাতেই খবরটি শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জাগান। আমিও রেডিও শুনে ঘণ্টাখানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করতে পারেনি, হত্যা করল বঙ্গসন্তান অবশ্য ওরা বঙ্গ সন্তান কিনা বা তাদের ধমনীতে কাদের রক্ত প্রবাহিত যাদের জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করেছেন, বছরের পর বছর জেল খেটেছেন নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং পাকিদের ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসে একটি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করলেন তারাই তার বুকে গুলি চালিয়ে ঝাঝরা করে দিল।
তারপর শুরু হল আজ এ ক্যু কাল ও ক্যু। আজকে এ ক্ষমতায় কাল ও ক্ষমতায়। খুনি মোশতাক এবং অন্যান্য খুনির বালিশ খেলা চলছিল এবং এর মাধ্যমে মোশতাক কৌশলে খালেদ মোশারফকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিল। তার আগে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, ও এইচএম কামরুজ্জামান কে কেন্দ্রীয় কারাগার আটক অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হলো। এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করার পর বাইনেট সার্জ করা হলো। এমন নৃশংসতা কেউ দেখেনি কখনো। একটি উদাহরণ শিশু শেখ রাসেল বলেছিল আমি মার কাছে যাব। সে কাঁদছিল অন্য হত্যাকাণ্ড দেখে। এক খুনি তখন তাকে বলল চলো তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই। বেগম মুজিব তখন ওয়াশরুমে। রাসেলকে পেয়ে তিনি বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। এর মধ্যেই খুনিরা ব্রাশ ফায়ার করে দুজনকে হত্যা করে। তখন বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন বলে বেঁচে যান। সর্বশেষ মঞ্চে আবির্ভূত হলেন খুনি মিলিটারি জিয়া অর্থাৎ ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের মূল লোক। ক্ষমতা দখল করেই বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর পথ ধরেন। আল্লাহর অশেষ কৃপা শেখ হাসিনা ছয় বছর প্রবাস জীবন শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আশায় দেশ আবার মূলধারায় প্রবাহিত হয়। দেশকে উন্নয়নশীল করে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করে জাতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোভিড-১৯, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার অযাচিত হস্তক্ষেপ এর পায়তারা বিশ্বকে লন্ডভন্ড করার পরও জাতির সকল সংকট মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে যাবেই।
লেখক- সংসদ সদস্য, এডভাইজার এডিটর দৈনিক পথে প্রান্তরে।