Search
Close this search box.

টুঙ্গিপাড়া সমাধিসৌধে মানুষের ঢল

টুঙ্গিপাড়া সমাধিসৌধে মানুষের ঢল

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

শোকের মাস শেষ হলো কয়েকদিন আগে। এবারের শোকের মাসের তাৎপর্য হলো অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে মানুষের ঢল ছিল অকল্পনীয়। গোটা বাংলাদেশ যেন ভেঙ্গে পড়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। পদ্মাসেতু খুলে দেয়ায় মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির কাফেলার পর কাফেলা ছিল পহেলা আগস্ট থেকে পনেরো আগস্ট পর্যন্ত। ১৫ তারিখের পরও এ ঢল কমেনি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুণী ও চক্রান্তকারীরা টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল টুঙ্গিপাড়া একটা অজ পাড়া গাঁ, কেউ যাবেনা শ্রদ্ধা জানাতে। বঙ্গবন্ধু হারিযে যাবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। আজ টুঙ্গিপাড়া বাংলাদেশের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এরচে বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। বাঙালি জাতির ঠিকানা এখানে অংকিত যেন শিল্পী হাশেম খানের হস্তাক্ষরের সংবিধান। সুবহে-সাদেক, ফজরের আযান হচ্ছে। মুয়াজ্জিন উচ্চারণ করছেন – “আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম (নামাজ নিদ্রা থেকে উত্তম)”। মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠ ভোরের নির্মল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তখনো। মুসল্লিগণ মসজিদের পথে ছুটছেন মুক্তির অন্বেষায়। তখন ৩২ নম্বও বাড়িতে চলছে গুলির পর গুলি। বাসভবনে লুটিয়ে পড়লো বাংলার হৃদয়। সিঁড়িতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত দেহ, সিঁড়ির গোড়ায় শেখ কামাল, দোতলায় শোবার ঘরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ আবু নাসের, কর্নেল জামিল অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, আরজু মনি, আব্দুর রব সিরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু নিথর নিস্তব্ধ। নবপরিণিতা দুই পুত্রবধূ শেখ সুলতানা কামাল, শেখ রোজি জামালের হাতের মেহেদী রঙ তখনো শুকোয়নি। কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলে বুকের তাজা রক্ত ঢালতে ঢালতে ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়ে বেয়ে গড়াতে গড়াতে বাংলার সবুজ মাঠ-ঘাট পথ-প্রান্তর ধুয়ে দিল। কি পবিত্র সেই রক্তের ধারা। ৪২টি বছর চলে গেল। আজও সেই রক্ত ধারা বাংলার মাটি ধুয়ে পবিত্র করে চলেছে। কী অসাধারণ কী অপ্রতিরোধ্য । একে থামিয়ে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। এই বাংলায় নেই, প্রাচ্য ছাড়িয়ে প্রতিচ্যেও নয়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে যেনো ডেকে বলে-তিষ্ট ক্ষণকাল, এখানে বাংলার হৃদয় ঘুমিয়ে আছে, একটু উষ্ণতা নিয়ে যাও পথিক, পথ হারাবে না তুমি। কে যেন একজন বলেছিল তোমরা বাংলার হৃদয়ের রক্ত ঝরিয়েছো ঠিকই এবং সেইসঙ্গে ঐ ৩২ নম্বরের বাসভবন কিংবা টুঙ্গিপাড়ার সমাধি তাবৎ মুক্তিকামী মানুষের তীর্থভূমিতেও পরিণত করে দিয়ে গেলে। ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিককে মহাকালের পথে থমকে দাঁড়াতেই হবে এখানে এই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। যেতে হবে টুঙ্গিপাড়ার সমাধি পাশে। বলতে হবে পিতা আমাদের ক্ষমা করুন।

হে বাংলার পুরনারী আপনারা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনের বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিবকে চেনেন কি? না চিনলে আমি চিনিয়ে দিচ্ছি দয়া করে মনযোগ দিয়ে শুনুন। বঙ্গমাতা হবার জন্যে তাঁকে রাজপথে গলাবাজি করতে হয়নি। অতি সাধারণ জীবন যাপন করেও অসাধারণ এক উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে আপনাদের সামনে যে উদাহরণ রেখে গেলেন আমি হলফ করে বলতে পারি আগত অনাগত প্রজন্মের জন্যে ভাবতে হবে না। বরং এক অভাবনীয় বর্ণাঢ্য জীবন লাভে সক্ষম হবেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব – একদিকে স্বামী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক সংসার সামলেছেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর রাজনৈতিক সংসারও ম্যানেজ করেছেন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতার মত। বঙ্গবন্ধু তো এক যুগেরও বেশি সময় পাকি মিলিটারি জান্তার কারাগারে কাটিয়েছেন। এর মধ্যেই শেখ হাসিনার মত সময়ের সাহসী একজন রাষ্ট্রনায়ককে উপহার দিয়েছেন। একজন শেখ কামালকে উপহার দিয়েছেন অনাগত তরুণদের স্বপ্নের নায়ক হিসেবে। বাংলার যে কন্যা শেখ হাসিনার জীবনের পাঠ নেবে তাকে জীবন-সংসার গোছাতে দ্বিতীয় পাঠ নিতে হবে না, যে তরুণ শেখ কামালকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করবে তাকে কোন পশ্চাদপদতা স্পর্শ করবে না, কোন কুপথ টানতে পারবে না, সন্ত্রাস, মাদকাশক্তি তার কাছেও ঘেষতে পারবে না।

বঙ্গমাতার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। খুব ছেলেবেলায় অর্থাৎ শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন হন এবং মাত্র তিন বছর বয়সে খেলার সাথীর মত বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী হিসেবে এই পরিবারে পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের আদর-যত্নে বড় হন। শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। লক্ষ্য করার বিষয় হল ১৯৭৫ সালের এই আগস্টের ১৫ তারিখ ঘটে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং কেবল বঙ্গবন্ধু নন; তাঁর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব; তিনপুত্র শেখ কামাল; শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ নবপরিণিতা সুলতানা কামাল ও রুজি জামালসহ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাসভবনের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশ মিলিটারির বিপথগামী সদস্যরা। অন্য বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের। সেদিন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত অনুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিঞার সাথে জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। ড. ওয়াজেদ সেখানে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণারত ছিলেন। এই শোকের মাসে বঙ্গমাতা ও শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা কতখানি কষ্টের? তারপরও দু’টি জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলেও শোক-গাঁথাই হয়েছে বেশি। সবাইতো আর খালেদা জিয়া নয় যে ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন ঘোষণা করে উৎসব করবেন। এ দিন সত্যিকার জন্মদিন হলেও তো করা উচিত নয়। একজন সাধারণ নাগরিকও এ দিন নিজের সত্যিকার জন্মদিনও পালন করে না। রুচিতে বাধে। বাধে না কেবল ঐ স্বশিক্ষিত ম্যাডামের। তাছাড়া তিনি তো আর সাধারণ নারী নন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে ভব্যতা আশা করাটা বেশি কিছু কি? অবশ্য এর জন্যে শিক্ষা, পরিবেশ ও ঐতিহ্য থাকতে হয়।

 

টুঙ্গিপাড়া সমাধিসৌধে মানুষের ঢল

 

শোকের মাসে দুটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন নাট্য ব্যক্তিত্ব পীযুষ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শেখ কামালের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি বন্ধুরা। তারা ‘সতীর্থ-স্বজন প্রকাশনা’ নাম দিয়ে ‘সতত প্রেরণাদায়ী বঙ্গমাতা’ ও ‘শেখ কামাল, উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’ শিরোনামে দু’টি সংকলনও প্রকাশ করে। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতার জন্মদিনের সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ দৈনিক ইত্তেফাক-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন এবং এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। আলোচনা করেন হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনিসহ কয়েকজন। শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিবের জীবন দর্শন শাশ্বত বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি। তুলনা হতে পারে কেবল অপর মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত অবরোধবাসি নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সংসার ধর্মের বাইরেও যে সমাজে রাষ্ট্রে নারীদের করণীয় আছে তার পথ দেখিয়েছেন, শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিবও বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক সংসার এবং রাজনৈতিক সংসার দু’টিই সমভাবে সামলেও যে গণমানুষকে পথ দেখানো যায়, সাধারণ গৃহবধূ হয়েও আন্দোলন সংগ্রামের পতাকা তুলে ধরা যায় তার অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। বেগম মুজিব কখনও তাঁকে পিছু টানেননি। বরং শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও যেমন ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংসার ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতাদের দিকনির্দেশনার পাশাপাশি অর্থেরও জোগান দিয়েছেন। সংসারের ধান-চাল বেঁচেও। নিজে যেমন বাঙালি মুসলমান গৃহবধূর মত সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। পোশাক-আশাকও তেমনি এবং রুচিসম্মত। এক মুহুর্তের জন্যেও মাথার কাপড় সরতো না। অনেক সময় অর্থাভাবে ছেলে মেয়েদের খাবার থালার ডাল চালের খিচুড়ির বাইরে কিছু দিতে পারেননি। এ জন্যে কোনো আফসোস ছিল না। বরং লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য। এমনকি বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসম্বাদী নেতা বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের পিতা বা রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হবার পরও অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হবার পরও বেগম মুজিবের পোশাক পাল্টায়নি, গায়ে বিদেশী শিপন ওঠেনি। ঠিক একইভাবে দেখা গেছে তাঁদের আদরের প্রথম সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আনতেন সাধারণ সূতি শাড়ি পরে। শেখ কামালকেও কখনো ইনশার্ট করে ক্যাম্পাসে আসতে দেখা যায়নি। ওপেন ফুলহাতা টি-শার্ট, প্যান্ট আর পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল। কোনদিন শ্যূট পরতে দেখা যায়নি। কেবল একবার দেখা গেছে বিয়ের সময়। ছাত্রলীগ করতেন কিন্তু কোনদিন নেতৃত্বের আসনে বসেননি। পরিবারের Culture ছিল “”Simple living high thinking”।

বেগম ফজিলাতুন্নিসা মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন- এই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কিন্তু বাসায় ধর্ম, দর্শন, মহাপুরুষদের জীবনী পড়তেন। শুনেছি বাট্রাণ্ড রাসেল পড়তে পড়তে ‘রাসেল’ শব্দটি পছন্দ হয় এবং এইভাবেই ছোট ছেলের নাম রাখেন শেখ রাসেল। রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি যেমন নিজের জীবনের উপলব্ধি দিয়ে শানিত করেছেন তেমননি ছেলেবেলা থেকেই মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী; তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রমুখকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। শেখ হাসিনাসহ সন্তানরাও এভাবেই বড় হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মত কালজয়ী ব্যক্তিত্ব তো ঘরেই রয়েছেন। আজকাল একজন নেত্রী নামের পেছনে ‘আপোষহীন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। অথচ বেগম মুজিব আন্দোলনে-সংগ্রামে কতখানি আপোষহীন, দেশের প্রতি কতখানি বিশ্বস্ত থেকেছেন তার একটি উদাহরণ – বঙ্গবন্ধু তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র চলছে। তৎকালীন মিলিটারি শাসক আইয়ুব খাঁ পশ্চিম পাকিস্তানে নেতাদের বৈঠক আহবান করলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন। কেউ কেউ এও বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা হোক চাইলে প্যারোলে মুক্তি দরকার। নেতাদের অনেকেই এ প্রস্তাবে রাজী ছিলেন কিন্তু বেগম মুজিব এত বড় আপোষহীন দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন যে স্বামীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও প্যারোলের বিপক্ষে দাঁড়ালেন এবং প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার জন্যে চিঠি লিখে কন্যা শেখ হাসিনা ও জামাতা ওয়াজেদ জিয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠালেন। সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক গবেষকগণ তাঁকে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসেবে মনে করেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এ বাড়ি সে বাড়ি আত্মগোপনের এক পর্যায়ে সন্তানসহ গ্রেফতার হয়ে ধানমন্ডির একটি বাড়িতে (সাব-জেল) ওঠেন। তার আগেই বড় দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামালকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে ভারতে পাঠিয়ে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না সেদিন শেখ রাসেলের বয়সও যদি ১৫/১৬ হত তাকেও পাঠিয়ে দিতেন দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে। শেখ হাসিনা তখন সন্তান সম্ভবা নয়তো তিনিও যুদ্ধে যেতেন।

বাংলাদেশের নারীরা অবহেলিত। বেগম রোকেয়ার ভাষায় অবরোধবাসিনী। তারপরও সংসার ধর্ম পালন করেও একজন নারী যে নিজের সন্তান-সন্ততি তথা পরিবারের বাইরেও বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত করতে পারেন তার প্রমাণ বেগম ফজিলাতুন্নিসা মুজিব। বেগম মুজিব যেমন সন্তানদের শিক্ষা দীক্ষায় মানুষের মত মানুষ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার মধ্যেও এই গুণাবলী লক্ষণীয়। শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় যেমন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইটি বিশেষজ্ঞ তেমনি কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও অর্টিজমের ওপর কাজ করতে করতে এখন জাতিসংঘ মহাসচিবের এডভাইজার। জয় যেমন হার্ভার্ড এডুকেটেড তেমনি পুতুলও বোস্টনের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। শেখ রেহানার ছেলে ববি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এখন জয়-পুতুলের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকেও সাহায্য করছেন। রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক তো বৃটেনের হাউজ অব কমন্স-এ ঝড় তুলছেন নির্বাচিত বৃটিশ লেবার পার্টি এমপি হিসেবে। রেহানার ছোট মেয়েও অক্সফোর্ড-এ লেখাপড়া শেষ করেছেন। অথচ অনেকেই জানেন না বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ রেহানা লন্ডনে বাংলাদেশ সেন্টারে রিসেপশনিস্টের চাকরি করেছেন।
আজও চোখ বন্ধ করলে সামনে ভেসে বেড়ায়- শেখ কামালের মুখচ্ছবি উজ্জ্বল, টল শ্যামলা গায়ের রং, ঘন কালো ব্যাকব্রাশ করা চুল, মোটা গোপ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মেদহীন পাতলা শরীর, হলেও আর দশটি তরুণের চেয়ে আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রাণোচ্ছল মেধাবী, উদ্যামী, পরিশ্রমী, দক্ষ সংগঠক এবং সৃষ্টিশীল। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর এত বড় ক্ষমতার ছত্রছায়া অর্থাৎ পিতার রাষ্ট্রক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তরুণ কেবল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য হয়েছেন। ইচ্ছে করলে বড় কোন পদে যেতে পারতেন। যাননি। এটাই ছিল এই পরিবারের স্বাতন্ত্র শিক্ষা, কালচার। মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৭৪। লাইব্রেরির পেছনে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। ভদ্রলোক টিপিক্যাল ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। আমরা তার ওখানে চা-সিঙ্গারা খেতাম। একদিন ঢুকে দেখি ছালার চট পরা কবি সাফদার সিদ্দিকীও চা খাচ্ছে। আমাকে চিনত কবি নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, সেলিম আল-দীন, আখতারুন্নবীদের (কবি ও লেখক) সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিল। এক পর্যায়ে সাফদার বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সম্পর্কে খুব আপত্তিকর কিছু মন্তব্য করল। তাকিয়ে দেখলাম ছাত্রলীগের কিছু কর্মী কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, সাফদার তোমার কথাটি উইড্র করো। সে করল না, তখন আমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছি এমন সময় আমার চেনা এক ছাত্রলীগ কর্মী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, শফিক ভাই, ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। ভালো করে গাঁজা খাওয়াব। বললাম, দ্যাখো ও কবি, কবিরা গাঁজা খেয়ে কত কিছু বলে, ও ধরতে নেই। আমি ওকে নিয়ে লাইব্রেরির পুব পাশে এসে একটা রিকশা ডাকলাম এবং হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বললাম, এই পথে চলে যাও, আজ আর ক্যাম্পাসে এসো না। আমি কলাভবনের দিকে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর কবি রফিক আজাদ ও কবি মহাদেব সাহা এসে বললেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা সাফদারকে ধরে নিয়ে গেছে। মাথা কামিয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরাবে এবং গাঁজা খাওয়াবে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে যেতে দেখলাম বন্ধুবেষ্টিত শেখ কামাল, কলা ভবনের গাড়ি বারান্দায়। কামালকে ঘটনাটা বললাম। শোনে সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনিও চলুন, কামাল সরাসরি ওদের ভিড় থেকে সাফদারকে হাত ধরে বের করে নিয়ে এলো এবং ওকে গাড়ির পেছনে এবং আমাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে স্টাট করে বলল, কোথায় যাবেন? বললাম প্রেস ক্লাবে নামিয়ে দাও। কামাল তা-ই করল। গাড়ি থেকে নামিয়ে সাফদারদের হাতে একটা নোট গুঁজে দিয়ে বললো, দু’তিনদিন আর ক্যাম্পাসে যাবেন না। নোটটা ভালো করে দেখিনি, পঞ্চাশও হতে পারে, একশ’ও হতে পারে। টাকাটা হাতে দিতে দিতে বলল, এত সুন্দর কবিতা লেখেন, গাঁজা খান ক্যানো?

বড় বোনের সহপাঠি হিসেবে তাকে দেখেছি দারুণ স্মার্ট আদব-কায়দা সম্পন্ন তরুণ। স্বাধীনতার পর প্রতিক্রিয়াশীল প্রতি বিপ্লবীরা যেভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের কুৎসা রটাচ্ছিল ঠিক একইভাবে শেখ কামাল সম্পর্কেও যা তা বানোয়াট কাহিনী প্রচার করছিল। তৎকালীন জাসদের মুখপাত্র ‘গণকন্ঠ’ পত্রিকা বা ভাসানী ন্যাপের ‘হক কথা’ এ ক্ষেত্রে জঘন্য ভূমিকা পালন করে। আমি কাজ করতাম ‘ইত্তেফাক’-এ তাতে নিউজ সেকশনের সতর্কতায়, বিশেষ করে মরহুম আসাফ-উদ-দৌলা রেজা ভাইর নেতৃত্বের কারণে হার্ড নিউজ-এ গণ্ডগোল করার সুযোগ না থাকলেও সম্পাদকীয় পাতায় খন্দকার আবদুল হামিদ, আবুল মনসুর আহমদরা গণকণ্ঠের অলি আহাদের ইত্তেহাদের ভূমিকা পালন করেছে। শেখ কামাল যে কেবল রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানের ছেলে তা তো নয়, সে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মদাতা পিতার সন্তান। একটা শ্রেণী কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছিল মাত্র। বিশাল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। সর্বশেষ দেখলাম এক স্বাধীনতা দিবসে দুর্নীতির মামলায় লন্ডন পলাতক জিয়া-খালেদার ছেলে তারেক শেখ কামালের কুৎসা রটালো। শেখ কামালের পায়ের নখের সমান শিক্ষা, যোগ্যতা যার নেই, বরং দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত, সে যখন কামালকে কটাক্ষ করে তখন ওদের আসল চেহারাই ফুটে ওঠে। শেখ কামালের মধ্যে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখছি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার মধ্যেও। শেখ হাসিনা যেমন সাদামাটা জীবন-যাপন করে তেমনি দেশের এক নম্বর পরিবারের সন্তান হয়েও শেখ কামাল ব্যবসায় নামেনি, হাওয়া ভবন-খোয়ার ভবন-ডান্ডি ডায়িং-কোকো ওয়ান টু গড়ে তোলেননি, বরং লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি যেমন করেছেন (ছাত্রলীগ) তেমনি আবাহনী ক্রিড়াচক্র, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী, ঢাকা থিয়েটার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেগুলো আজ এত বছর পরও আধুনিক স্পোর্টস, সঙ্গীত এবং নাটাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে চলছে। বস্তুত “Simple living high thinking” বঙ্গবন্ধু পরিবারে চর্চা হতো বলেই তাদের মধ্যে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দের পরিবর্তে দেশ ও জাতির স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে।

আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাটছে। পদ্মাসেতু আজ কল্পনা নয়। বাস্তবতায় রুপদান করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশের আত্মপ্রত্যয়ী নাগরিক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে ৮৫/৯০-এর মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হত এবং এখন আমরা আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের ফ্লাইওভারে হাটতাম। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যোগসাজসে তাদের এজেন্ট মোশতাক-জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায়। হত্যা করায় বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠ জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রব সেরানিয়াবাতকে। বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে হত্যা করে যাতে ভবিষ্যতেও এ পরিবারের আর কেউ দেশের হাল ধরার সুযোগ না পায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, Emergence of Bangladesh is my personal defeat. এই মানসিকতা তারা পরিহার করেছে বলে মনে হয় না আজও। মুলত বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেবার পর থেকেই কিসিঞ্জাররা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু না ৬ দফা, না উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, না মুক্তিযুদ্ধে বিজয় কোনটাই ঠেকাতে না পারলেও চক্রান্ত অব্যাহত রাখে। মুক্তিযুদ্ধে মাঝেই মোশতাক-জিয়া ভারতের মাটিতে বসেই চক্রান্ত শুরু করে। মুজিব নগর গর্ভমেন্ট জানতে পেরে তাদের Inactive করে রাখে। কিন্তু পশুর খাসলত যার সেকি সংশোধন হয়? আর তাই ৭৪-এ দুর্ভিক্ষ লাগিয়েও যখন দেখল দেশের অগ্রগতি এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ঠেকানো গেল না তখনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল। তাই আজ দাবী ওঠেছে হত্যাকান্ডের পেছনের কুশীলবদেও মুখোশ উন্মোচনে তদন্ত কমিশন গঠনের। আগেই বলেছি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু খুনি মোশতাক-জিয়ার চররা আজও তৎপর। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যে ১৯ বার হামলা করা হযেছে-চট্টগ্রাম, নাটোর, জামালপুর, ৩২ নম্বরের বাসভবন, রাসেল স্কোয়ার, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ -কিন্তু আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে আছেন এবং জাতি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ভাড়াটিয়া খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফারুক যেমন টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে জিয়ার সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছে তেমনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান বলেছে হওয়া ভবনে তারেকসহ বসে কিভাবে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলা করা হয়েছে, যাতে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন নেতাকর্মী ঙহ ঃযব ংঢ়ড়ঃ নিহত হয়েছেন এবং তিন শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। ঢাকায় তখনকার মেয়র মুহম্মদ হানিফ, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গ্রেনেডের ইসপ্লিন্টার বয়ে আলটিমেটালি ইন্তেকাল করেন। আজও অনেকে শরীরে ইসপ্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। চক্রান্ত শেষ হয়ে যায়নি। আজও সরকারের কাছাকাছি ঘাপটি মেরে আছে। আমরা যেনো না ভুলি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব যেমন ছিল অপ্রতিরোধ্য তেমনি শেখ হাসিনাও আজ বিশ্বের প্রথম কাতারের রাষ্ট্রনেতা। আমাদের সতর্কতা জরুরি।

লেখক: সংসদ সদস্য, এ্যাডভাইজার এডিটর দৈনিক পথে প্রান্তরে

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ