Search
Close this search box.

শেখ হাসিনার ভারত সফর ॥ বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ

শেখ হাসিনার ভারত সফর ॥ বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রথমে কোভিড-১৯, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তৃতীয়তঃ তাইওয়ানের ওপর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার চোখ এবং চীনের চ্যালেঞ্জ- সব মিলিয়ে বিশ^ পরিস্থিতি এক অজানা শংকার দিকে এগিয়ে চলেছে। শান্তির আকাক্সক্ষা দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হচ্ছে। তারমধ্যেও বাংলাদেশ এমন এক শক্ত ভীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এর কৃতিত্ব সময়ের সর্বোচ্চ সাহসী- মেধাবী প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ।

এই শংকার মধ্যেও বাংলাদেশ বিশ^ মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পদ্মাসেতুর মতো অসাধ্য সাধন করেছে। আমাদের পথের বিরোধীদল বিএনপি পদ্মা সেতু নির্মাণের বিরোধীতা করে এখন মিথ্যেও বেসাতিতে নিমজ্জিত। কখনো বলছে জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে, কেউ উঠবেন না, ভেঙ্গে পড়বে। এখন আবার বলছে ১০ হাজার কোটির স্থলে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সবকিছুতেই জনগনকে বিভ্রান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে, এবার খালেদা জিয়া এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন একথা বলে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এটা ঠিক, মিলিটারী জিয়া থেকে খালেদা জিয়া তাদের ২১ বছরের ক্ষমতাকালে দুই তিন ইটা বসানো ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। এমনকি তারা গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবী করলেও তাতে দেখা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা জাতীয় প্রেসক্লাবের ভবন নির্মাণের জন্য গড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস বলে কয়েকখানা ইট গেঁথে আর ওমুখো হয়নি। জিয়া একটি পয়সাও ফাইন্যান্স করেননি। কখনও কখনও আমি ইউ-টিউবে দেখি রুমিন ফারহানা এমন ভাষায় কথা বলে যা কেবল বিশেষ অঞ্চলের ভাষা হতে পারে- ভদ্র সমাজের না।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ৪ দিনের সফরে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। এই সফর নিয়ে ফখরুলদের কত যে রসিকতা তা দেখে সাম্প্রতিক একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে আমার। সংবদিটি হলো পাবনা মানষিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন পর আবার রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে।

এখানে আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। ভারতে মোদী যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন তখন বিএনপি- জামাতের কিছু নেতা ভারতে চলে যান। কেউ ধূতিও নিয়ে গিয়েছে গিয়ে পড়বে বলে। কিন্তু রেজাল্ট ঘোষনার পর যখন বললেন-‘ বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা (ভারতের), ১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। এবারও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাথে পাশাপাশি দুই দেশের বিকাশে কাজ করবো। যেই না বলা ওমনি ধূতি –পাজামা ফেলে দে দৌড়।

বর্তমান বৈশ্বিক সংকটে সব দেশেরই সীমাবদ্ধতা বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে যে ৭ টি চুক্তি সম্পাদন হয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য চুক্তিটি হচ্ছে কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য সমঝোতা। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ। এই সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টিতে পানি উত্তোলনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে ৫৪টি যৌথ নদী রয়েছে সেগুলোর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সাধারণত তিস্তার পানি বণ্টনের প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে সবচেয়ে এলেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে এই একটি নদী কুশিয়ারার পানি বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ চুক্তিাটর ফলে সাতটি উপজেলার ৬,০০০ হেক্টরের মতো জমি সেচের আওতায় আসবে এবং সারা বছর কৃষি কাজ করা সম্ভব হবে। রহিমপুর খালটি ভারতের সাথে সীমান্তের খুব কাছে। সে কারণে যৌথ নদীটি থেকে পানি উত্তোলন ও খাল খননে এই সমঝোতার প্রয়োজন হয়েছে। এখন পানি উত্তোলনে আর কোনো বাঁধা রইলো না। ফেনী নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের অনুরোধের বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক সভায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রেলসংযোগ উন্নয়ন সম্পর্কিত টঙ্গী-আখাউড়া লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর; বাংলাদেশ রেলওয়েতে রেলওয়ে রোলিং স্টক সরবরাহ; ভারতীয় রেলওয়ের স্বনামধন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ; বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার উন্নতি নিশ্চিতে আইটি-সংক্রান্ত সহযোগিতা প্রদান; বাংলাদেশ-ভারত রেলসংযোগের উন্নয়নে গৃহীত নতুন উদ্যোগ; কাউনিয়া-লালমনিরহাট-মোগলঘাট-নিউ গীতালদহ রেল সংযোগ; হিলি ও বিরামপুরের মধ্যে রেলসংযোগ স্থাপন; বেনাপোল-যশোর রেলপথ ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা এবং রেলস্টেশনের মানোন্নয়ন; বুড়িমারী ও চ্যাংড়াবান্ধার মধ্যে রেলসংযোগ পুনঃস্থাপন; সিরাজগঞ্জে একটি কনটেইনার ডিপো নির্মাণ। এসব অগ্রগামী প্রকল্পের জন্যে বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিতার অধীনে একাধিক আর্থিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকল্পসমূহের অর্থায়ন নিশ্চিতকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অনুরোধে অনুদানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০টি ব্রডগেজ ডিজেল লোকোমোটিভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। রেল যোগাযোগ এবং রেল মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য এই পদক্ষেপগুলোকে যুগান্তকারী উল্লেখ না করার সুযোগ নেই। তাছাড়া বিনা ভাড়ায় ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধাও হলো অনেকদিন পর।

বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের কাক্সিক্ষত সরবরাহ নিশ্চিতে বিশেষ ব্যবস্থায় দুদেশের মধ্যে পণ্য সরবরাহের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। পাশর্^বর্তী দেশ এবং আমদের ব্যবসায়িক ও স্বাস্থ্যসেবার নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মানুষ ও পণ্যের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ চলাচলের সুবিধা নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে চলমান উন্নয়নমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্নকরণ, যার মধ্যে চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন ক্রসিং এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং বাণিজ্য-সম্পর্কিত অবকাঠামো রয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় একটা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। যার ফলে প্রায়ই অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। একটি শান্ত ও অপরাধমুক্ত সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ত্রিপুরা সেক্টর থেকে শুরু করে সমগ্র সীমান্তের কাঁটাতারবিহীন অংশগুলোতে কাঁটাতার নির্মাণের কাজ শেষ করার বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত একমত হয়। পাশাপাশি সীমান্ত রক্ষাবাহিনী কর্তৃক পদক্ষেপের মাধ্যমে সীমান্তে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসকরণ। অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকার চোরাচালান এবং পাচার রোধে বিশেষত নারী ও শিশুপাচার রোধে পারস্পরিক সহযোগিতাও প্রশংসিত হয়েছে। সন্ত্রাস নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলায় ঐকমত্যে এসেছে দু’দেশই এবং সন্ত্রাসবাদের সব রূপ ও অভিব্যক্তি নির্মূলে তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। শুধু এ অঞ্চলেই নয়, এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা এবং মৌলবাদের বিস্তার প্রতিরোধে ও সে সম্পর্কিত পদক্ষেপে সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে ঢাকা-নয়াদিল্লি।

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তির অধীনে সফল পরীক্ষামূলক চালান সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগকারী মৈত্রী সেতুটিও চালু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এবং ভারত বাংলাদেশকে রামগড়ে অবশিষ্ট অবকাঠামো, অভিবাসন এবং শুল্ক সুবিধা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য অনুরোধ করেছে। উভয়পক্ষের বাণিজ্যবিষয়ক কর্মকর্তাদের ২০২২ সালের মধ্যে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে এবং ২০২৬ সালের আগে এটি সম্পূর্ণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২৬ বাংলাদেশ তার এলডিসি অবস্থা থেকে উন্নীত হবে এবং বর্তমানে ভোগ করা শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধাগুলো ধরে রাখতে উদ্যোগ নেবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পণ্য চলাচলের সুবিধার্থে, দেশের ব্যস্ততম স্থলবন্দর, বেনাপোল-পেট্রাপোল আইসিপিতে একটি দ্বিতীয় মালবাহী গেট নির্মাণের উদ্দেশ্যে তহবিল গঠনের জন্য ভারতের দেওয়া প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে উভয়দেশ একমত পোষন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর ওপর যৌথভাবে নির্মিত বায়োপিক- ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব ন্যাশন’ খুব শিগগির শেষ হবে এবং আগামী বছর মুক্তি পেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্রের যৌথ প্রযোজনা এবং দুর্লভ ভিডিও ফুটেজের যৌথ সংকলনে সম্মত হয়েছে উভয়পক্ষ। ২০১৮ সাল থেকে বিনামূল্যে ভারতের নামকরা হাসপাতালে ১০০ জনেরও বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা প্রদানে ভারতের উদ্যোগ প্রশংসার দাবী রাখে। মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, গ্রিন এনার্জি, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পরিসেবাগুলোতে যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে কাজ করতে ভারত আন্তরিকতা প্রকাশ করেছে। এছাড়া সুন্দরবন সংরক্ষণে যৌথ উদ্যোগ নেয়ার কথা আলোচনায় এসেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত সহযোগিতা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া এবং মানবিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত এসব লোকদের নিরাপদ, টেকসই এবং দ্রুত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতে ভারত তার অব্যাহত প্রতিশ্রুতির ওপরে জোর দিয়েছে। ভারত বিমসটেক সচিবালয়ের আয়োজনে এবং এর অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশের অবদানের প্রশংসা করেছে। ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় পক্ষ তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বার্তা সংস্থা এএনআইর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পরিপক্ক। দেশটির উৎপাদন খাতের বিস্তৃত ভিত্তি এবং অবকাঠামো প্রকল্পে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি এশিয়ায় ‘লক্ষ রাখার’ মতো একটি অর্থনীতি হতে পারে। অর্থাৎ এশিয়ায় দৃষ্টান্ত হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম উদাহরণ সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতু। যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, এটি চালু হওয়ায় তারাই এখন বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

চলতি বছরের বসন্তকালীন সভায় করোনা মহামারি মোকাবিলা এবং এর প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে সব নীতি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বন্যা মোকাবিলায় পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেয়া। কেবল মানবিক সাহায্য দিয়ে বন্যা মোকাবিলা করা যায় না। এর জন্য দরকার আগে-পরে বেশ কিছু সতর্ক পদক্ষেপ। বন্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত উন্নয়ন, প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি ও বন্যা চলাকালে বহুমুখী আর্থিক সংস্থান। বন্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশের এ তিনটি ব্যবস্থাই রয়েছে। বন্যা চলাকালীন নেয়া পদক্ষেপ ছাড়াও বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলো গবেষণার মাধ্যমে বন্যার পূর্বাভাস সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করে। এতে বন্যা হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া যায়। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মোবাইলে মেসেজ করে বন্যার খবর জানিয়ে দেয়া হয়, এলাকার মসজিদগুলোতে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়, স্বেচ্ছাসেবকদের বড় একটি দল শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করে। বন্যার সময় খাদ্য, অর্থ, মোবাইল রিচার্জ দিয়ে বন্যার্তদের সাহায্য করে থাকে সরকার ও অন্যান্য সংস্থা। যথেষ্ট পরিমাণে পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় বড় রকমের বন্যা হলেও জানমালের ক্ষতি অনেকটাই কমে যায়। বিশেষ করে মৃত্যুর হার কমে আসে অনেকটাই।

ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানেরই একটি অংশ, সে বছর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। স্বাধীনতার এত বছর পর ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সে মৃত্যুর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩০ জনে। বাংলাদেশ তার পুরোনো ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং দুর্যোগ প্রতিরোধে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের থেকে পাকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলোর শেখা উচিত কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে সংশোধন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড উন্নতি করেছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার। ২০০৬ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩ হাজার ৩৭৮ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট এবং একদিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

কৃষি থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জাহাজ নির্মাণ থেকে গার্মেন্টস শিল্প, প্রতিনিয়ত বৈচিত্র্যময় হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি। পাশাপাশি বাড়ছে রফতানিও। বাংলাদেশের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনীতিকে সমানভাবে চাঙা রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ অর্থ প্রণোদনা এবং বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ দেশের রিজার্ভ গড়ে তুলতে সাহায্য করছে, যাতে সহজেই আমদানি চাহিদা মেটানো যায়। গত ২৫ জুন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করে ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ সড়ক-রেল সেতুর (পদ্মা সেতু) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও মেট্রোরেল, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, কর্ণফুলি টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ এবং স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে সংকুচিত হওয়া জরাজীর্ণ রেল সেক্টরের আমূল সংস্কার, রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের মতো উদ্যোগে প্রশংসা কুড়াচ্ছে বাংলাদেশ।

মার্কিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতেও সময় লাগবে অন্তত ১২৫ বছর। এ ছাড়াও নরওয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন রিচার্ড পারকিনসন তাদের ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে।’ তবে এসব মন্তব্য-সমালোচনা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর উন্নয়নের সূচকে আজ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এএনআই বলেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ এবং মোংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সংস্কার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। যা বাংলাদেশ সরকারের একটি সাফল্য।

চীনের পর তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া বর্তমান সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সহজ ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা তৈরি করেছে। এর ফলে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এরই মধ্যে সরকারের রফতানি বাড়ানো এবং আমদানি কমানোর নীতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। করোনা মহামারির শুরুর দিকে অনেক প্রবাসী তাদের চাকরি হারানোয় অনেকে ধরে নিয়েছিল যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমবে। তবে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সাফল্যের কারণে অনেক বাংলাদেশি বিদেশে তাদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে পেরেছেন এবং আগের মতোই অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ১০০ নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগ (স্টার্টআপ) ও ছোট প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। ‘ফোর্বস এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ’ শিরোনামের এ তালিকায় ‘এডুকেশন অ্যান্ড রিক্রুটমেন্ট’ বিভাগে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রযুক্তি (এডটেক) স্টার্টআপ ‘শিখো’। শিখো হলো এমন একটি টিউটরিং প্ল্যাটফর্ম যেখানে লাইভ লেকচার, অনলাইন মক টেস্ট, নোট এবং অ্যানিমেশনের মাধ্যমে হাইস্কুলের পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয়। দৈনিক পাঁচ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে শিখো’র। তথ্য প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের অগ্রগতি ইতোমধ্যে ব্যাপক সারা ফেলেছে। তরুণ প্রজন্মের নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মে অংশগ্রহন অর্থনীতির চাকাকে আরো গতিশীল করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দেশবিরোধী চক্রান্ত বন্ধ করে সবাইকে এক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো সুদৃঢ় হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, বিচক্ষণ রাজনীতি ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দেশকে উন্নত থেকে উন্নততর করছে। আজ জনগণের প্রত্যাশার শেষ ঠিকানা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরই সঠিক দিক নির্দেশনায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো।

লেখক- এ্যডভাইজার এডিটর, দৈনিক পথে প্রান্তরে ও সংসদ সদস্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ