Search
Close this search box.

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা লড়াই ভোটের লড়াইয়ে গড়াক

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা লড়াই ভোটের লড়াইয়ে গড়াক

বিভুরঞ্জন সরকার

বিএনপি একদিকে সরকারের কাছে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিতের জন্য আবেদন করছে, অন্যদিকে ‘এই মুহূর্তেই সরকারের পদত্যাগ’ দাবি করছে। সরকারের কাছে আবেদন এবং পদত্যাগ দাবি কি বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলের দুর্বলতাই প্রকাশ করে না? এ সংক্রান্ত খবরগুলো আগে দেখে নেওয়া যাক।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে : ষষ্ঠবারের মতো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করেছে তাঁর পরিবার। আজ রোববার বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই সংক্রান্ত আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বিজন কান্তি দাস আবেদনপত্রটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। আবেদনে একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও তাঁর বিদেশে চিকিৎসার বিষয়েও সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

এই আবেদন জমা দেওয়ার আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, স্বজনেরা আবেদন করলেই নির্বাহী আদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আবারও বাড়ানো হবে। দীর্ঘদিন ধরেই এই অবস্থা চলছে। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বলেন, সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন নয়, আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে। আবার আবেদন নিবেদনও অব্যাহত আছে। আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্তি দিতে সরকারকে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি বিএনপি তৈরি করতে পারছে না। ফলে আবেদনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়াকে জেলের বাইরে রাখা হচ্ছে।

বিএনপি অবশ্য বলতে পারে, আবেদন দলের পক্ষ থেকে করা হয় না, করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু মানুষ কিন্তু যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে। আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে যে বিএনপি মুক্ত করতে পারবে না, এটা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার এটা স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে শাস্তির মেয়াদ স্থগিত করছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর সরকার অগ্রাহ্য করে আসছে। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দুই প্রধান দলের মধ্যে কথার লড়াই চলছে, চলবে। কিন্তু ভোটের লড়াই থেকে বিএনপির দূরে থাকা ঠিক হবে না।

বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে যতটা অসুস্থ বলে প্রচার করে, ততটা অসুস্থ তিনি নন। দেশের চিকিৎসায়ই তিনি সুস্থ থাকবেন। বিএনপি সেই কবে থেকে বলছে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা দেশের চিকিৎসায় ভালো হবে না, কিন্তু তিনি ভালো হয়ে প্রতিবারই বাসায় ফিরছেন। কারো কারো কাছে সরকারের মনোভাব অমানবিক বলে মনে হলেও সরকারের প্রতি বিএনপির আচরণ কতটা মানবিক সে প্রশ্ন সরকারি মহলে থাকাটাই স্বাভাবিক। সবশেষ চলতি বছরের মার্চে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত আবেদন করা হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ মার্চ সাজা স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের সেই মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। এরপর দফায় দফায় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। কারামুক্তির পর থেকে নানা রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়া বর্তমানে গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায় অবস্থান করছেন। চিকিৎসার জন্য প্রায়ই হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। সম্প্রতি আবারও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হলে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যতটা সদ্ভাব থাকা দরকার তার সামান্যও নেই। বিএনপি নেতারা এমন ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেন, যা বিএনপির প্রতি সরকারের সহানুভূতি তৈরি না করে আরও ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়। একটি খবর লক্ষ করুন : আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানি করেছে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শুধু পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় থাকতে ভারতে গিয়েছেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বেইমানি করেছে। ভারতে গিয়েছে শুধু পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় থাকতে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক হোক আমরাও চাই, সে সম্পর্ক আজ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে আমাদের দেশের এক মন্ত্রী বলেছে।’

দেশের বর্তমান সংকটময় অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে ফখরুল বলেন, ‘তারা দেশে লুটপাটের অর্থনীতির রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে কিছুই আনতে পারেননি। দেশের সংকটময় অবস্থায় তিনি জয়পুরে নৃত্যে অংশ নিয়েছেন। এটা মানুষ কখনো মেনে নেবে না।’ ফখরুল আরও বলেন, ‘আজকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। মামলা, হামলা, গুলি করে বাংলাদেশের মানুষকে থামানো যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামী।’ সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষ বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস একদিকে যেমন বঞ্চনার, তেমন সংগ্রামের। বাংলাদেশের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে অবৈধভাবে, এখন সত্য কথা বলাটাই অপরাধ। ১৯৭১ সালে আমরা একটা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করলেও স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। স্বাধীনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারিনি। আমরা জাতি হিসেবে এখানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি।’ ফখরুল বলেন, ‘১৯৭২ সাল থেকেই দেশে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দেশ যাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী কাঠামোতে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে বাকশাল কায়েম করে আওয়ামী লীগ। বাকশাল কেন তৈরি করা হয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরটা আওয়ামী লীগের কেউ দেয় না, সেই প্রশ্ন তোলেও না।’

১৯৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জালিয়াতি ও কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, ‘তখনো তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেছিল। ঢাকায় এনে ব্যালট বাক্স গণনা করেছিল। আওয়ামী লীগ কোনো দিন সমাজতন্ত্রকে বিশ্বাস করেনি, আজকে সেই দল বলে সমতার কথা। তারা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আস্থাপূর্ণ হওয়ায় বিএনপির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। বিএনপি দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। দলটির নেতারা এই ব্যর্থতা আড়াল করতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে নানান অপপ্রচারে লিপ্ত।

প্রধানমন্ত্রী আবারও ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারত সফরে গিয়েছিলেন, মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা কাউকে ক্ষমতায় বসাবে এমন উদ্ভট কথা আপনারা বিশ্বাস করলেও আমরা করি না। ক্ষমতায় কে থাকবে, সেটা নির্ভর করে দেশের জনগণের ওপর। জনগণই আমাদের আস্থার ঠিকানা ও ক্ষমতার উৎস।‘ ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতার জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয় না। বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, কোনো প্রভু নেই। আওয়ামী লীগ দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে। জনগণের ওপর আমাদের আস্থা শতভাগ।
ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী দুই প্রধান দলের মধ্যে কথার লড়াই চলছে, চলবে। কিন্তু ভোটের লড়াই থেকে বিএনপির দূরে থাকা ঠিক হবে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ