ফিরোজ মান্না
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আরও একটি কালো দিন ২১ আগস্ট। এই দিন ‘৭৫ সালে বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জন নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদরীয় নেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস আরও ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। রচিত হয় একটি কালো অধ্যায়। বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চাকারী যে কোনও দেশেই বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এ ধরনের বর্বর হামলা নজিরবিহীন ঘটনা। তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে। ন্যাক্কারজনক এ ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থায়ী ‘অবিশ্বাসের’ জন্ম দিয়েছে। আর এই ক্ষত নষ্ট করে দিয়েছে রাজনীতির পারস্পরিক ন্যূনতম বোঝাপড়ার জায়গাটিও। মতপার্থক্য থাকলেও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে আগে যে ধরনের সমঝোতার সম্পর্ক চলে আসছিল ২১ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর তা দৃশ্যত আর অবশিষ্ট নেই। বরং ঘটনার পরম্পরায় অবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে কোন কোন দিন আসে সূর্যের প্রখর তীব্রতা নিয়ে, কোন কোন দিন অমাবস্যার রাতের চেয়েও অন্ধকারময়। বাঙালী জাতির ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, ঠিক তেমনি এক ভোরে ইতিহাসের কালপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক, কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। এই হত্যাকাণ্ড স্তব্ধ করে দেয় বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অর্জিত আমাদের রক্তস্রত স্বাধীনতাকে। জাতির জনককে হত্যা করা হবে একথা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী বিশ্বনেতৃত্বও কোনদিন বিশ্বাস করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষও তো একথা কোনদিন কল্পনাও করেনি। করার কথাও নয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আগে ও পরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বধানী চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়োজিত জনসমাবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সন্ত্রাসের শিকার হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। হামলার ধরন ও প্রচণ্ডতা থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, শেখ হাসিনা ও তার দলের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করাই ছিল ওই গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণের উদ্দেশ্য। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ দলের ২২ নেতাকর্মী এবং তার দেহরক্ষীসহ মোট ২৪ নিহত হন। অভিযোগ আছে, ওই ঘটনার পর দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই রোমহর্ষক আলামত নষ্ট করে ফেলে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদতে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে হেন কোনও কাজ নেই, যা করেনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাজানো হয় ‘জজ মিয়া নাটক’। এমনকি সংসদে দাঁড়িয়ে ভেনিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলা হয় খোদ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই। সেদিন এই ঘটনার জন্য যে মামলা করা হয়েছিল সেই মামলাটি ছিল প্রহসনের।
পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে তদন্তপূর্বক বিচার কাজ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে নিম্ন আদালত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে। এতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। রায়ে সরকারের কয়েকটি সংস্থার কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সাজা দেয়া হয়েছে।
সূত্র মতে,২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চক্র ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জিয়াপুত্র তারেক রহমান বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র গড়ে তোলে হাওয়া ভবনে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দীন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেএমবির ঘাতকরা। এই পুরো নীলনকশা হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের মস্তিষ্কজাত। খুনীরা চেয়েছিল নির্বিঘ্নে এই হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় খুনীদের সেই দুরাশা পূরণ হয়নি। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে আজ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের ধারায়। চালকের আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যে দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বাঙালী জাতির ভাগ্যের উন্নয়ন সাধন করা। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
ওয়ান এলিভেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। আদালত প্রমাণ পেয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা পরিচালিত হয়েছে। এ জন্য তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের নীতিনির্ধারকরা দায়ী। রায়ে সরকারের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণও মেলে। তারা মঞ্চায়ন করেছে ‘জজ মিয়া’ নাটক। এ ঘটনা বিএনপিকে নৈতিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত করেছে যে, ভবিষ্যৎ সমঝোতার রাজনীতির আর কোনো পথ খোলা নেই। দীর্ঘ ১৪ বছর পরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ে ১৯ জনের ফাঁসির আদেশ এবং আরও ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এ ছাড়াও আদালত ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। ষড়যন্ত্রীদের কাছে বারবার আঘাত পেয়েও ভাগ্যক্রমে জিতে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পালিয়ে যাওয়ার নয়; বরং বিপদের দিনে একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দল আওয়ামী লীগ। এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা দলীয় কর্মকান্ডে আরও গতিশীল হয়েছে। গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ আরও সুসংগঠিত হয়। কর্মীরা ত্যাগের প্রমাণ দিয়েছে নিজ দলের জন্য। আজ প্রতিহিংসার নৃশংসতম সেই ভয়াল একুশে আগস্টের দিন। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন দিন যেন কোন দিন না আসে। প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশ থেকে নির্মূল হোক।