Search
Close this search box.

বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণের ক্ষেত্রে কৌশলী হতেই হবে

বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণের ক্ষেত্রে কৌশলী হতেই হবে

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

সাম্প্রতিক সময়ে-ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পৃথিবীতে যে দুইটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো জ্বালানি তেলের সংকট এবং বিদ্যুতের ঘাটতি। এটা ঠিক যে এই যুদ্ধের ফলে যে মানবিক বিপর্যয় দুই দেশে নেমে এসেছে সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এই যুদ্ধের ফলে উভয় দেশেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে সামরিক এবং বেসামরিক প্রচুর মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। একবিংশ শতাব্দিতে এই ধরনের যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। তাছাড়া এই যুদ্ধের প্রভাব শুধুমাত্র ওই দুই দেশের সীমাবদ্ধ নেই।

আমরা এখন বৈশ্বিক অঞ্চলে বাস করি। ফলে এক দেশের অচলাবস্থা অন্য দেশগুলোকে প্রভাবিত করবে-এটাই স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি যে জ্বালানি তেল এবং গ্যাস রফতানিতে রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম। এই যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার ওপরে যে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে তারই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাস রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে জ্বালানি তেলের মূল্য যেমন ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে গ্যাসের দাম বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই গ্যাস এবং জ্বালানি তেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে পিক আওয়ার এবং অফপিক আওয়ারের মধ্যে বিদ্যুতের দামের তারতম্য দেখা যাচ্ছে। সেই সকল দেশের সরকার তাদের জনগণের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার জন্য। ইউরোপের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিদ্যুৎ ঘাটতির খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে একঘরে করার প্রয়াস নেতিবাচকভাবে গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে তাঁর একটি বক্তব্য বলেছেন যে একটি দেশকে শাস্তি প্রদান করতে গিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়।

বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বাংলাদেশ গত সাড়ে ১৩ বছরে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ কিংবা জ্বালানি তেল, এলএনজি গ্যাস অথবা কয়লা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এই সকল জ্বালানির ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে বিধায় সরকারকে বাধ্য হয়েই আমদানি বন্ধ করতে হচ্ছে। একই সাথে আমাদের দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত কোরবানি ঈদের কয়েকদিন আগে এই অবস্থা তৈরি হয়েছিল বিধায় সরকার বাধ্য হয়েই বিভিন্ন অঞ্চলে লোডশেডিং করতে বাধ্য হয়েছিল। পৃথিবীব্যাপী চলমান এই জ্বালানি সংকট এবং তৎপরবর্তী বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এই নির্দেশনাগুলোকে বিদ্যুৎ ঘাটতি যেন না হয় সে বিষয়ে অগ্রিম একটি পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে- যা একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জ্বালানি তেলের মজুদ ঠিক রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে সহনীয় মাত্রায় লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে যদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় তাহলে খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না সরকার এবং দেশবাসীকে। আর এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৪ ঘণ্টায় এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হবে। পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের কর্মঘণ্টা কিছুটা কমিয়ে এনে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এমনকি বিভিন্ন শপিং মল এবং দোকান রাত আটটার পরে খোলা না রাখার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তগুলোকে একটি গোষ্ঠী নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে বৈশ্বিক জ্বালানি ঘাটতি এবং বিদ্যুতের মূল্য এবং ঘাটতির কথা বিবেচনা করে সরকার যদি এই ধরনের একটি পরিস্থিতির মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করতে পারে তাহলে এটি হবে সরকারের একটি বড় সফলতা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে কখন যুদ্ধ শেষ তবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া গোটা পৃথিবীর মানুষ এক ধরনের ব্যতিক্রমী সময় অতিবাহিত করছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য খাত বিপর্যস্ত হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। আমরা ইতোমধ্যেই জানি যে কোভিড-১৯ এর স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য গত দু’বছরে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করার জন্য সরকার বিপুল অর্থ খরচ করে টিকা ক্রয় করে বিনামূল্যে জনগণকে টিকা প্রদান করার মাধ্যমে মানুষের প্রাণ রক্ষা করবার চেষ্টা করেছে। ফলে, কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে সামনের সারির দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। এমনকি টিকা প্রদানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সামনের সারির দেশগুলোর মধ্যে।

যেখানে বেশিরভাগ রাষ্ট্র কোভিড-১৯ এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ সফলভাবেই শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত প্রভাবই মোকাবিলা করেনি দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশের ওপরে মানুষকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করবার মতো সফলতা দেখিয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবেও দেশেকে একটি শক্ত অবস্থানে রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এমতাবস্থায় আগামী দিনগুলোতে যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকে, তাহলে জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে- এই বিষয়টি চিন্তা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় যদি স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে তবে সেটি হবে সরকারের আরেকটি সফলতা। আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীর সকল দেশ গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে একটি ব্যতিক্রমী সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। বিশ্বে এই ব্যতিক্রমী অবস্থার প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে অনেক দেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা একই কারণে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বেশ কয়েকটি দেশ দেউলিয়া হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
আমাদের সৌভাগ্য যে বাংলাদেশ সেই তালিকাকে নেই যার অর্থ হলো বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। যদিও নিন্দুকেরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা হবে এই মর্মে তথ্য প্রচার করছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনা করে বলা যায় যে শ্রীলঙ্কার মতো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটার সম্ভবনা নেই। তবে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করার জন্য সরকারকে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিতেই হবে। আপদকালীন সময় মোকাবিলা করবার দায় শুধু মাত্র সরকারের নয়। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। আপদকালীন সময়ে শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা না করে সরকারকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির হয়েছে, অতএব দেশবাসীর উচিত এই সময় বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাশ্রয়ী হওয়া। একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয় সে জন্য সরকার যে সমস্ত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করা। এতে যদি নিজেদের কিছুটা কষ্ট হয় তবে তা মেনে নিয়ে সরকারকে সমর্থন করা উচিত।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে স্বল্পমেয়াদে কষ্ট করে যদি দীর্ঘমেয়াদি লাভ হয় সেটি হবে বড় সফলতা। সরকারের তরফ থেকে আগামী দিনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের এবং বিতরণের ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটি যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। এই সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সহায়তা প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে নিজেদের অবস্থান থেকে সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলবে এবং এই সমস্যা থেকে আমরা অচিরেই মুক্তি পাবো।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ