স্টাফ রিপোর্টার ॥ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কাশেম জুট মিল গেট এলাকায় অবস্থিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লেগে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪১ জনের মৃত্যু হয়। আগুন ও বিস্ফোরণে নিহতদের শনাক্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ডিএনএ টেস্ট শুরু হয়ে গেছে। তাতে করে ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তাদের হস্তান্তরও করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের ওপরে মানুষ দগ্ধ ও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে।
আজ সোমবার সকাল ৯টা থেকে ঢাকা থেকে আসা অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষজ্ঞ দল নমুনা সংগ্রহ শুরু করেন। নিঁখোজদের স্বজনেরা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে থাকেন। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি বুথ করা হয়। সেখানে বসেই স্বজনদের ডিএনএ সংগ্রহ করতে থাকেন সিআইডি বিশেষজ্ঞেরা।
নিহতদের স্বজনেরা পুলিশের সহায়তায় ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা দেন। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন আসার পর পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিআইজি আনোয়ার হোসেন জানান, মোট ৪১টি মরদেহ চমেক হাসপাতাল আনা হয়েছিল। এরই মধ্যে ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ায় তাদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকিদের লাশের পরিচয় নিশ্চিতকরণের জন্য স্বজনদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন আসার পর স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
বাবার খোঁজে ডিএনএ নমুনা দিতে মায়ের কোলে চড়ে হাসপাতালে এসেছে সাত মাসের ফাইযা রহমান। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বিএম কনটেইনার ডিপোতে আইসিটি দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সোবহানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরই মেয়ে ফাইযা।
ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার নাগরৌহা গ্রামের ফায়ার ফাইটার কর্মী শফিউল ইসলাম (২২) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের ২ দিন পেরিয়ে গেলেও শফিউলের খোঁজ না মেলার কারণে পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে উৎকন্ঠা বিরাজ করছে।
আরও চারটি কনটেইনারে নাকি রাসায়নিক রয়েছে বলে সেনাবাহিনী ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে তা নিশ্চিত হয়েছে সেনাবাহিনী। আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম দুর্ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সেনাবাহিনী গতকাল রোববার থেকে দুর্ঘটনাস্থলে কাজ করছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, আরও চারটি কনটেইনারে রাসায়নিক রয়েছে। যেসব কনটেইনারে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে, তা বন্ধের চেষ্টা চলছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর বাকি কাজ করা হবে।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস হোসেন চৌধুরী জানান, নিহতদের মধ্যে ডিপোর শ্রমিকদের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যও রয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, বিস্ফোরণ ও আগুনে মোট ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মরদেহ পাওয়া গেছে ৪১ জনের। তাই নিহত মানুষের সংখ্যা ৪১।’
আরও পড়ুন : সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ : নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে
ভয়াবহ এ দূর্ঘটনায় পরিচয় শনাক্ত হওয়া নিহতরা হলেন- বাঁশখালী উপজেলার ফরিদুল আলমের ছেলে মুমিনুল হক (২৪), মাহমুদুর রহমানের ছেলে মহিউদ্দিন (৩৪), দক্ষিণ বালিয়াপাড়ার সিহাব উদ্দিনের ছেলে হাবিবুর রহমান (২৩), চালিয়াপাড়ার আব্দুল আজিজের ছেলে রবিউল আলম (১৯), হাসান আলীর ছেলে তোফায়েল আহমেদ (২৩), আব্দুল রশিদের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫), নিজাম উদ্দিনের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫), নিজাম উদ্দিনের ছেলে সুমন (২৪), আবুল কাশেমের ছেলে ইব্রাহিম (২৭), মো. আসিফের ছেলে নয়ন (২২), দক্ষিণ হালিশহর এলাকার আব্দুল ছবুরের ছেলে হারুনুর রশিদ (৩৫), সামসুল হকের ছেলে মনিরুজ্জামান (৩২), সাত্তারের ছেলে ফারুক জমাদার (৫৫), আমিন উল্লাহ’র ছেলে শাহাদাত উল্লাহ (৩০), শাহ আলমের ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৯), সোহরাব মিয়ার ছেলে তৌহিদুল হাসান (৪১), জাফর আহমদের ছেলে রিদুয়ান (২৪), আব্দুল সত্তার তরফদারের ছেলে শাকিল তরফদার (২২) চিত্তরঞ্জন চাকমার ছেলে নিপন চাকমা (৪৫), কামরুল মিয়ার ছেলে রানা মিয়া (২২), সোলাইমান মিয়ার ছেলে আফজাল (২০) ও আবু ইউসুফের ছেলে সালাউদ্দিন কাদের (৫০)।
বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যের মধ্যে ৮ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তকৃতরা হলেন- কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার মো. রানা মিয়া, নার্সিং এটেনডেন্ট মনিরুজ্জামান, ফায়ার ফাইটার আলাউদ্দিন, ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদার, লিডার মিঠু দেওয়ান, সীতাকুন্ড ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী , ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম, লিডার নিপন চাকমা।
আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারানো দুই ফায়ার ফাইটারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে রাঙ্গামাটিতে। শেষকৃত্যের আগে তাদের দুইজনকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় ফায়ার সাভির্সের তরফ থেকে। নিহত মিঠু দেওয়ান ও নিপন চাকমা দু’জনই পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির সন্তান।
চট্টগ্রাম সিআইডির এডিশনাল এসপি জাহাঙ্গীর আলম নমুনা সংগ্রহে নেতৃত্বে দিচ্ছেন জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, যেসব স্বজন দুর্ঘটনায় নিখোঁজ আছে দাবি করছেন, তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিখোঁজের বাবা-মা, ভাই-বোন, কিংবা সন্তানদের মধ্যে যেকোনো দুজনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেসব লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, সেগুলোর নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।
লাশ হস্তান্তরের সময়ই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বজনদের নগদ ২ লাখ টাকার চেক এবং দাফন-কাফনের যাবতীয় খরচ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের দপ্তরের এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম। বিস্ফোরণে আহতদের দেখতে সকাল ১০টায় চমেক হাসপাতালে আসেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ায় স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের লাশ ডিএনএ পরীক্ষার পর হস্তান্তর করা হবে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ৪১ জন মানুষ নিয়ত হওয়ার সাথে শতাধিক মানুষ দগ্ধ ও আহত হয়েছেন। প্রায় ২০০ মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ২২ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তাদের হস্তান্তরও করা হয়েছে।