স্বদেশ রায়
শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই অর্থনীতিতে কম-বেশি ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। আর এটা হঠাৎ ঘটেনি। কোভিডের প্রথম বছরের শেষেই একমাত্র অর্থনীতিবিদরা নন, প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, প্রকৃত শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী, প্র্যাকটিক্যাল ইকোনমি খেয়াল করেন এমন বড়মাপের সাংবাদিক সকলেই বলতে শুরু করেছিলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা আসবে। সব দেশকে তা মোকাবিলা করতে হবে। ওই সময়ে যেসব দেশ বা তাদের সরকারের ব্যক্তিরা মনে করেছিলেন, কোভিড তাদের অর্থনীতিকে ধাক্কা দিতে পারেনি বা পারবে না তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন শুধু নয়, অর্থনীতি বিষয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্নও নন।
অর্থনীতিবিদ বা আর যারা প্রকৃত বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তারা তখন বলেছিলেন এক বছরের ধাক্কাকে হিসাব করে। কিন্তু কোভিড তার পরে আরও এক বছর পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্তব্ধ করে রাখে। তাই স্বাভাবিকভাবে এই ক্ষত অনেক গভীরে চলে যায়। আর এই যে ক্ষতটা সৃষ্টি হচ্ছিল, এটা কেন বুঝতে পারেনি অনেকে এ একটা বড় প্রশ্ন। আসলে বুঝতে না পারার সব থেকে বড় কারণ হতে পারে, বোঝার জন্যে যে তথ্য-উপাত্তগুলোর ওপর ভর করতে হয় ওগুলো সঠিক ছিল না। কোনও গোষ্ঠী সেগুলোকে নানান স্বার্থে পরিবর্তন করে, হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে বড় করে উপস্থিত করেছিলেন।যেমন সম্প্রতি নাইজেরিয়ান একজন প্রফেসরের সঙ্গে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পরিচয় ঘটলো। আমার ইচ্ছা ছিল তাঁর সঙ্গে নালিউডের মুভি নিয়ে আলাপ করা। বাস্তবে হলিউডের থেকে নালিউডের মুভি আমার বেশি পছন্দের। কারণ, নালিউডের মুভির অনেক বাস্তবতার ক্ষেত্রে কখনও কখনও হলিউড বা বলিউডের মুভির থেকে বেশি মনে হয়। তাছাড়া আফ্রিকান সংস্কৃতির ভেতর যতটা না আমাদের সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাই এমনটি ঠিক পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে ঘটে না। কিন্তু আলোচনা সেখানে বেশি সময় থাকেনি। অল্প সময়ের আলোচনার ভেতরই বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি এসে যায়। তিনি বললেন, তার দেশ অনেক বড় দেশ ও তেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই অর্থনৈতিক মন্দায় অনেক বড় বিপদে পড়বে। কারণ হিসেবে বললেন, তাঁর দেশের সব ধরনের ব্যাংকগুলো খুব খারাপ ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছে।
তাছাড়া সরকারের ক্ষমতাবানদের সহযোগিতায় অনেক ব্যাংকের অর্থ ব্যাংক থেকে নানানভাবে বাইরে চলে গেছে। যা আর ফেরত আনা সম্ভব নয়। আর এই মন্দায় দরিদ্র শ্রেণিকে যখন ক্যাশ সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন– যেমন, ইউরোপীয় দেশগুলো দিচ্ছে, এই সক্ষমতা তাদের নেই। কারণ, দেশের অধিকাংশ ব্যাংক দুর্বল- সেখানে জনগণ যে অর্থ রেখেছিল তা নেই। অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে এই মন্দার ভেতর তাদের বিদেশি ঋণ শোধ করার চাপ বাড়বে। এবং সে চাপটাও বড় হবে। কারণ, তাঁর দেশ এদিক থেকে খুব খারাপ করেছে– অর্থাৎ অবকাঠামো উন্নয়ন ও উৎপাদন সমন্বয় করে দেশের উন্নয়ন করেনি। যারা যে প্রজেক্ট ধরিয়ে দিয়েছে– তাদের দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসন ও অনেক দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক সেটাই ব্যক্তিস্বার্থে বা সোজা কথায় অবৈধ অর্থ পাওয়ার লোভে গ্রহণ করেছে।যাহোক, আলোচনার একপর্যায়ে তাকে বলি, দেখো, এ তো শুধু তোমার দেশের চিত্র নয়, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চিত্র এই। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশিভাগ দেশের। আর এটা তো শুরু হয়েছে নব্বইয়ের দশক থেকে গোটা পৃথিবী মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ঢুকে যাওয়ার পরে। আর তাতে নতুন যোগ ঘটে ২০০৫-এর পর থেকে চীনের বেশি পরিমাণে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে নানান দেশে যাওয়া শুরু করা বা তাদের ঋণ কূটনীতি চালু হওয়ার পর থেকে। তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশই নব্বইয়ের দশক থেকে এই মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে ঠিকই– তবে অধিকাংশ দেশ ভুল করেছে তারা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে জনগণের আর্থ-সামাজিক সকল দিকের উন্নয়ন না ঘটিয়ে- শুধুমাত্র দেশের ব্যবসায়ীর উন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হয়েছে বেশি।মুক্তবাজার অর্থনীতির যে দর্শন অর্থাৎ জনগণের ক্ষমতায়ন ও জনগণের স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত এই মূল চিন্তা থেকে অনেক দেশ সরে যায়। তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে অটোক্রেটিক অর্থনীতি গ্রহণ করে অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর নীতিকে অনুসরণ করে। তারা মনে করে, চীন বা রাশিয়ার মতো জনগণের স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব করলে উন্নয়ন দ্রুত করা সম্ভব। এবং অবকাঠামো উন্নয়ন হয়ে গেলেই জনগণের উন্নয়ন হবে স্বাভাবিকভাবে। জনগণের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন বা আর্থসামাজিক সক্ষমতার উন্নয়নকে আমলে নেননি। এমনকি এটাও আমলে নেননি, উন্নয়ন ও মানুষের অভাব বা ঘাটতি সত্যি অর্থে বুঝতে হলে জনগণের সব ধরনের স্বাধীনতার প্রয়োজন। জনগণের মত প্রকাশ ছাড়া সঠিক চিত্র কখনোই পাওয়া যায় না। আর সঠিক চিত্র ছাড়া সঠিক কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
যাহোক, বাস্তবে এখন কোভিড পরবর্তী পৃথিবীর পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে যারা কিছুটা অটোক্রেটিক পথ ধরেছিল সেই দেশগুলোই সমস্যায় পড়ছে বেশি। এবং তাদের নামগুলোই ক্রমেই শ্রীলংকার সারিতে এসে দাঁড়াচ্ছে। এখন একবার যখন একটা শ্রীলংকা ঘটে গেছে, এই ঘটনা শ্রীলংকার জন্যে যতই খারাপ হোক না কেন, বিশ্বের এই সারিতে যেসব দেশ আছে তাদের জন্যে কিছুটা হলেও মঙ্গলের। কারণ, তারা একটা সিগন্যাল আগেই পেয়ে গেছে যে এ মুহূর্তে সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা না নিলে অর্থনীতি কত দ্রুত খাদে গিয়ে পড়তে পারে। এবং সেখান থেকে উদ্ধার হওয়ার পথও কমে গেছে। যেমন, শ্রীলংকা যে খাদে পড়ে গেছে এখান থেকে সহজে বের হতে পারবে না। তাদের দীর্ঘ সময় লাগবে।
তাই শ্রীলংকার মতো খাদে পড়ার আগে এই সারিতে যে দেশগুলো আছে শুধু ওই দেশগুলো নয়, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা নতুনভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। আর ঢেলে সাজাতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় নেওয়া প্রয়োজন। তার ভেতর প্রথমেই প্রত্যেক দেশকে সঠিকভাবে পরিমাপ করতে হবে, কোভিডে তার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত কতটা ক্ষতি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ শুধু অর্থনৈতিক নয়, পুরো আর্থ সামাজিকভাবে কতটা বিপর্যয়ে পড়েছে। এর সঠিক তথ্য-উপাত্তসহ প্রকৃত চিত্র বের করতে হবে।এরপরে অবশ্যই এ বাস্তবতা মাথায় নিতে হবে, এই কোভিড উত্তর ভঙ্গুর অর্থনীতির সময়ে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ঘিরে পশ্চিমা বিশ্ব বনাম পুতিনের যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। এবং এই যুদ্ধের আরও একটি চরিত্র হলো, এই যুদ্ধ আমেরিকা বা রাশিয়ার আফগানিস্তান আগ্রাসন বা তারও আগে আমেরিকার ভিয়েতনাম আগ্রাসনের যুদ্ধের থেকে ভিন্ন। কারণ, এই যুদ্ধ শুধু সামরিক অস্ত্রে হচ্ছে না। এখানে পশ্চিমা বিশ্ব পুতিনকে পরাজিত করার জন্যে সমরশক্তির যুদ্ধের বাইরে গিয়ে অর্থনৈতিক শক্তির যুদ্ধকেও কাজে লাগাচ্ছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই যুদ্ধের প্রভাব এ মুহূর্তে যেমন পড়েছে, তা আরও বাড়বে। পাশাপাশি এই প্রভাবে দরিদ্র দেশগুলো বা শ্রীলংকার লাইনে থাকা দেশগুলোর অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে ধনী দেশগুলোরও দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার ক্ষমতা কমে যাবে। এমনিতেই এই যুদ্ধের বেশ আগে থেকেই দাতা দেশ হিসেবে ইউরোপীয় দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে যে বাজেট সহায়তা বা অন্যান্য দারিদ্র্য দূর করার কাজে দান সহায়তা দিতো- সে সক্ষমতা ইউরোপীয় দেশগুলোর কমে গেছে। ইউরোপের বাইরে দাতা বা স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার সব থেকে বড় দেশ ছিল জাপান। এরপরে এসেছে চীন। তবে চীন দাতা দেশ বা স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া দেশ নয়, সে সুদ ব্যবসায়ী দেশ। তার ঋণের সঙ্গে আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে এমনকি একসময়ের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে মহাজনী ঋণ প্রথা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে নিঃস্ব করেছে– ওই মহাজনী ঋণের একটা চরিত্র আছে। তারপরেও তাদের ঋণের চরিত্র যাই হোক না কেন, পৃথিবীতে যে যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি হয়েছে তাতে সব দেশেরই ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। যেমন এ মুহূর্তে যতই টেনশন দেখা যাক না কেন, তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকা ও চীন যুদ্ধে জড়াবে না। কারণ, আমেরিকা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে একসঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি ঠেকাবে। তারা হিটলারের মতো ভুল করবে না।
অন্যদিকে আমেরিকা আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে আছে এটাকে সুযোগ মনে করে চীন যুদ্ধে যাবে না তাইওয়ান নিয়ে। কারণ, চীন অটোক্রেটিক দেশ হলেও একেবারে পুতিনের মতো এক ব্যক্তিনির্ভর দেশ নয়। সেখানে তাদের থিংক ট্যাঙ্ক আছে, তাদের পার্টি আছে। পার্টি সম্পূর্ণ স্বাধীন না হলেও সেখানে নেতৃত্বের পরিবর্তন হওয়ার পথ একেবারে বন্ধ নয়। আর এ মুহূর্তে অন্তত দুই জন তরুণ নেতা জি জিং পিংয়ের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন। তাই জিং পিং আর যাই হোক পুতিনের মতো কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না। তবে তারপরেও এই সামরিক উত্তেজনায় তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাবেই কারণ, সামরিক ব্যয় বাড়বে দেশটির।এ মুহূর্তে চীন সামরিক বাজেট জাপানের থেকে পাঁচগুণ। তারা যে পথে এগোচ্ছিল তাতে ২০৩০-এ গিয়ে তাদের সামরিক বাজেট জাপানের থেকে নয়গুণ বাড়াতো। কিন্তু এই তাইওয়ান টেনশনের পরে এই সামরিক বাজেট তাদের আরও বাড়বে। অন্যদিকে জাপান ২০২১ সালেই তাদের সামরিক বাজেট ৪৫.১ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫৪.১ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যায়।
শুধু এই জাপান ও চীন নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান টেনশনসহ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় টেনশনের ফলে ইউরোপের দেশগুলোরও সামরিক বাজেট বাড়াতে হচ্ছে। জার্মানি ও ফ্রান্স ইতোমধ্যে তাদের সামরিক বাড়িয়েছে। ইউরোপীয় যে দেশগুলো নতুন হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে তারাও সামরিক বাজেট বাড়াবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভালো অর্থনীতির দেশগুলো সকলেই তার সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে। আর এই সামরিক বাজেট বাড়ানোর ফলে তাদের সকলেরই ঋণ ও দাতা হিসেবে দান সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। তাছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে।
এ অবস্থায় মূলত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ- ই থাকবে মূল ঋণদাতা সংস্থা হিসেবে। সকল দরিদ্র দেশ ও দুর্বল অর্থনীতি বা কোভিড ও বিশ্বের এই সামরিক শক্তির প্রভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে সহায়তা দেবার জন্যে মূলত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আই এম এফ এর সঙ্গে ছোট আকারে এডিবি ও আইডিবি হবে মূল ভরসা। কম সুদে ঋণ পাবার প্রতিষ্ঠান ও দেশ এর বাইরে আর থাকছে না। কিন্তু বাস্তবে কি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আই এম এফ এই সব দুর্বল অর্থনীতির দেশকে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা দিতে পারবে? পারবে না। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের যে পরিমাণ সহায়তা দেবার সক্ষমতা আছে তার তুলনায় সহায়তা পাবার জন্যে হাত পাতবে অনেক বেশি দেশ। অর্থাৎ বিষয়টি এ মুহূর্তে সারা বিশ্বে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের সাহায্য’র বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বা উদ্বাস্তু সাহায্য সংস্থার ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তেমনটি হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সাহায্য সংস্থার ইচ্ছে থাকলেও সারা পৃথিবীর উদ্বাস্তু মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয়টুকু করতে পারছে না। কারণ, তাদের সমর্থের তুলনায় পৃথিবীর দেশে দেশে উদ্বাস্তু বা রিফিউজির সংখ্যা অনেক বেশি। তেমনই আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঋণ দেবার সক্ষমতার তুলনায় এখন সাহায্য প্রার্থী দেশের সংখ্যা বেড়ে যাবে।এই বাস্তবতায় প্রত্যেকটি দেশকে নিজের সম্পদের ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করেই দেশ ও জনগণকে রক্ষা করতে হবে। আর এ রক্ষার কাজে তার প্রথম প্রয়োজন সঠিক ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনায় কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে বেশি তা শ্রীলংকার অবস্থা থেকে স্পষ্ট হয়েছে। শ্রীলংকার যে সমস্যা ছিল তা এখন অনেক বেশি চিহ্নিত। অন্যদিকে নাইজেরিয়ার ওই অধ্যাপক তাঁর দেশের যে সমস্যা চিহ্নিত করছেন এর অনেকগুলোই মিলে যায় শ্রীলংকার সঙ্গে। আর বাস্তবে এই সমস্যাগুলোই মূলত বর্তমানে কোভিড ও যুদ্ধ ছাড়াও দুর্বল করেছে অনেকগুলো দেশের অর্থনীতি। কারণ, শ্রীলংকা ও নাইজেরিয়ার বড় অংশের রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা চীনসহ যেসব দেশ ঋণ কূটনীতি ও ঋণ ব্যবসা করে তাদের ঋণের সঙ্গে থাকা লুটপাটের বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে শ্রীলংকা, নাইজেরিয়া সহ এ ধরনের দেশগুলোর সবখানে জনগণের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে হাওয়া হয়ে গেছে রাষ্ট্রের অবৈধ সমর্থন পাওয়া একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। তাই এখন এই দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঢুকতে হলে ঋণ ও জনগণের অর্থ লুটপাটকারী এবং তাদের সহায়তা দেওয়া রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষমতার পাশ থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
প্রত্যেক দেশকে দূরদৃষ্টি ও বর্তমান বাস্তবতাকে সঠিক উপলব্ধি করতে সমর্থ এমন অর্থনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঢুকতে হবে। যে অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হবে জনগণকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের আর্থ- সামাজিক ক্ষমতায়ন করা। এবং এর পাশাপাশি উৎপাদন ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঠিক সমন্বয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বড় সুবিধা আছে। সেটা তার অভ্যন্তরীণ বাজার। অভ্যন্তরীণ বাজারের এই ক্রেতারা যাতে ক্রেতা হিসেবে সক্ষম থাকে এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পরিকল্পনা বা ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই অভ্যন্তরীণ বাজার অর্থনীতিকে দ্রুত শক্তি জোগাতে সমর্থ হবে। তাই সব মিলিয়ে বর্তমানের এ সময়ে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহণ করা ছাড়া সত্যি অর্থে বিকল্প খুব বেশি হাতে নেই– এই কোভিডের ধাক্কার পরে যুদ্ধ ও সামরিক ব্যয় বেড়ে যাওয়া পৃথিবীতে। এ সত্য মাথায় রাখতে হবে, আগামী দিনে ধনী দেশ বা ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো থেকে খুব বেশি সহায়তা মিলবে না। আর নিজের সামর্থ্যের ওপর ভর করে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান না করে, নতুন আরও ঋণে জড়িয়ে যাওয়াও উচিত নয়। কারণ, কম সুদের ঋণ হলেও সেটাও তো শোধ করতে হবে সুদে আসলে। এ বাস্তবতাকেও মাথায় রাখতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।