Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: কারণ ও ফলাফল

নূহ-উল-আলম লেনিন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেখতে দেখতে সাতচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেল। তারপরও বারবার একগুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে, কেন কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল? তাদের সেই উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে? মুজিব হত্যাকাণ্ডের চারদশক পর কোথায় দাঁড়িয়েছে তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ?

বঙ্গবন্ধুকে কারা হত্যা করেছে তা তো হত্যাকাণ্ডের কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ জানতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রেডিও ঘোষণায় তা সদম্ভে প্রচার করেছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুক প্রমুখ প্রকাশ্যেই হত্যাকাণ্ড ও হত্যা পরিকল্পনার কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। আর সর্বশেষ শেখ হাসিনার নেৃতত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের শুনানি ও রায় থেকেই সমগ্র বিশ^বাসী আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধীদের পরিচয় জানতে পেরেছে। এখন প্রশ্ন হলো হত্যাকারীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল? তাদের উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে?

আজকে আমাদের মনে সেই প্রশ্নও উঠেছে বিএনপি-জামায়াত জোট কি কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি নাকি নৈতিকভাবে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অপরাধী?
এ কথা তো স্পষ্ট, কেবল ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করাই হত্যকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল না। ব্যাপারটা যদি শুধু কতিপয় বিপথগামী বা ক্ষুব্ধ (যেমনটি অনেকে ব্যাখ্যা করে থাকেন) সামরিক অফিসারের ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা হতো তাহলে তো এর রাজনৈতিক ফলাফল হতো ভিন্ন। সরকার পরিবর্তন যদিও হতো কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেওয়া অথবা বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের মীমাংসিত প্রশ্নকে পুনরায় অমীসাংসিত করে তোলা হতো না।

অতএব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ভাবাদর্শগত ও রাজনৈতিক কার্যকারণ খুঁজতে হবে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধুর সরকারের অনুসৃত নীতি পদক্ষেপের মধ্যে।
সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। নিঃসন্দেহে বাঙালি মুসলমানের তাতে সম্মতি ছিল। সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে আচ্ছন্নতার মধ্যে সাময়িকভাবে হলেও বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের মধ্যে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি এবং বিকাশের সম্ভাবনা দেখেছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠী অচিরেই দেখতে পেল প্রকৃতপক্ষে তারা একটা অলীক স্বপ্নের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। অবশ্য এরকম একটা স্পষ্ট উপলব্ধিতে পৌঁছতে তাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বাঙালি মুসলমানের একটা অগ্রসর অংশই কেবল বুঝতে পেরেছিল ব্রিটিশ শাসনামলের পর তারা নুতন করে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ করে সংখ্যায় মেজরিটি থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সবকিছু হারিয়ে ফেলে। জনাব জিন্নাহ সাহেব, যাঁকে অনেকে নেতা বলে মানতেন, বাঙালিকে এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে ফেলে দিয়ে করাচিতে রাজধানী স্থাপন করলেন।…’

ওই একই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল নয় মাসেই হয় নাইÑস্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের পর থেকে। তারপর ধাপে ধাপে সে সংগ্রাম এগিয়ে গেছে। সে সংগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। তাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয়। একদিনে সে সংগ্রাম চরম পর্যায়ে পৌঁছে নাই। নয় মাস আমরা যে চরম সংগ্রাম করেছি, সে সংগ্রাম শুরু করেছি বহুদিন থেকে।…’২৩ ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই সংগ্রামকেই সংজ্ঞায়িত করা হয় ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ হিসেবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে আমাদের সংবিধানের কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন করেন। প্রথমেই সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করে সংবিধানের তো বটেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ললাটে একটা ধর্মীয় ছাপ মেরে দেন। তারপর সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ কথাটি প্রতিস্থাপিত করেন। এই একটিমাত্র বাক্য প্রতিস্থাপনের ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতিকে তার গৌরবোজ্জ্বল অতীত সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রয়াস পান। তিনি ব্যাপারটাকে নয় মাসের একটা সামরিক যুদ্ধে সীমিত করে ফেলেন। একই সঙ্গে প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটিও কেটে দিয়ে নতুন করে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ সংযোজিত করেন। জিয়াউর রহমান সংবিধানে সবচেয়ে গুরুতর যে সংশোধনী আনেন, তা হলো রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের শেষাংশটির কর্তন। জিয়া রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ধর্মনিরক্ষেতা কেটে দেন এবং সমাজতন্ত্রকে সামাজিক ন্যায় বিচারে রূপান্তর করেন। পক্ষান্তরে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের যেখানে ছিল ‘… তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকার তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।’

২৪ অংশটি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় সামরিক ফরমান বলে বাতিল করে দেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ কেটে দেওয়ার সঙ্গে ৩৮ অনুচ্ছেদের এই শেষাংশটি বাতিল করে একদিকে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য যেমন খর্ব করা হয়, তেমনি ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক দল ও রাজনীতি করার বাধা তুলে নেওয়া হয়। ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে বৈধ রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবিদার জিয়া এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল এবং যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান শাহ আজিজের মতো পাকিস্তানের দালাল ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সহযোগী মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী, রাজাকার আব্দুল আলিম ও মওলানা মান্নানকে মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধকেই যেন চরম অপমান করেন। আর জিয়ার পথ অনুসরণ করে ষোলকলা পূর্ণ করেন আরেক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ। এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রথম ভাগের ২(ক) অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংযোজন করেন।

বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা না করলেও এই দুটি সংবিধান সংশোধনীর ভেতর দিয়ে কার্যত এদেশকে একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার-বিরোধী বৈষম্যমূলক সংশোধনী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এসবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, কেবল বঙ্গবন্ধু নন, বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবনভর যেসব আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং যেসব আদর্শ ও মূল্যবোধের তিনি প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, জিয়াউর রহমান সেসব আদর্শের মূলে কুঠারাঘাত হানেন। অত্যন্ত সচেতনভাবেই তিনি সেসব আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লজিককেই জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা-নিজামীরা অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন ও ধর্মনিপেক্ষতা কর্তনের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিপরীতে ভাষা-সংস্কৃতি-ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং নৃ-তাত্ত্বিক জাতীয়তার ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লজিককেই জিয়া ও তার ভাবাদর্শের অনুসারীরা অর্থহীন করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে ’৪৭-এর ধারায় টেনে নামিয়েছিল। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় তারা ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন’ করে বাংলাদেশকে আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় ‘মুসলিম বাংলায়’ পরিণত করার চেষ্টা করেছেন।

সত্য বটে, বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেন, তাতেও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা ছিল। বাঙালি মুসলমানের চেতনা, পাকিস্তানের প্রতি জনগণের মনোভাব এবং শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করেই একজন কুশলী রাজনীতিবিদ ও স্ট্র্যাটেজিশিয়ান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কৌশলগত কারণে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা ৬-দফায় সন্নিবেশিত করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ও কৌশল ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। জেনারেল আইউব খান সে কারণেই ৬-দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দিয়েছিলেন।
লাহোর প্রস্তাবের কথা বলা হলেও ৬ দফা আন্দোলন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ এবং ব্যাপ্তি শেষ পর্যন্ত ৬-দফাকে অতিক্রম করে যায়। স্বাধিকারের দাবি স্বাধীনতার একদফায় পর্যবসিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর নিজের কথায় এই সংগ্রামের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘শুধু ভোটের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে, রক্তের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ-সংগ্রামে। …জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে। এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আমি বাঙালি, আমার ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ।’২৫
ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। … আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে নিয়ে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার, এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’

২৬ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিপরীতে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি রচনা করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এখানেই ক্ল্যাসিক্যাল বাঙালি ও ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার পার্থক্য। ‘ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মের সংমিশ্রণ তার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। রামমোহন থেকে গান্ধী অবধি অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের চিন্তা ও সাধনায় রাজনীতি ধর্মের দৃষ্টিতে বিবেচিত হয়েছে। প্রাচীন ধর্মের গরিমায় জাতীয়তাবোধ উদ্দীপিত হয়।’ কথাটি হিন্দু মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার এই দুর্বলতাই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের জমিন তৈরি করেছে। অথচ এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যক্তিগতভাবে একজন ধর্মভীরু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তায়, জাতীয়তাবোধে কোনো ধর্মাশ্রয়ী মতাদর্শ স্থান পায়নি। উপমহাদেশের বড়মাপের অন্য নেতাদের মধ্যে এখানেই বঙ্গবন্ধু অনন্য।

বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সঙ্গে অধ্যাত্ম সাধনাকে কখনোই এক বলে ফেলেননি। ধর্মকে তিনি মানুষের ব্যক্তিগত বিশ^াস ও অধিকার বলেই গণ্য করতেন। সম্পূর্ণ ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই তিনি শোষিত-বঞ্চিত মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন। এক শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন-আকাক্সক্ষাই তার সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রাদর্শে অভিব্যক্ত হয়েছে। তিনি মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রী বা বিপ্লবী ছিলেন না। কিন্তু ষাট ও সত্তর দশকের প্রবল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তিআন্দোলন এবং চিরায়ত ধনতন্ত্রের পথ এড়িয়ে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের ‘মিথ’ তাঁকেও প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামাজিক মুক্তির অঙ্গীকারের কারণেই তিনি তাঁর মতো করে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং শোষিত-বঞ্চিত মানুষের, তাঁর ভাষায় ‘দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’র ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুর এই উন্নয়ন-দর্শন-প্রতিফলিত হয়েছে।

দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি তাঁর এই অবস্থানকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁর এসব নীতি পদক্ষেপের জন্য একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, সামরিক-অসামরিক এলিট শ্রেণি এবং সুবিধাবঞ্চিত মধ্যবিত্তরা ক্ষুব্ধ হয়েছে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারসমৃদ্ধ রক্ষণশীল দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের অনুসৃত নীতির বিরোধিতা করেছে, তার ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে।

সত্তরের দশকের বিশ্ব পরিস্থিতিও এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে। এ কথা সুবিদিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নিক্সন-কিসিঞ্জারচক্র তাদের ব্যক্তিগত পরাজয় হিসেবে মনে করেছেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ-বিরোধী নীতি-অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে মুজিববিরোধী করে তোলে। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনাকেই কেবল অস্বীকার করা ও অপমানিত করা হয়নি, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মূলেও যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে মাথানত করেননি। কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না, নিজ দেশবাসীর ওপর তাঁর এই প্রবল শিশুসুলভ বিশ্বাস নিজের নিরাপত্তার প্রতিও উদাসীন করে তুলেছিল। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে এই একটি জায়গায় বঙ্গবন্ধুর অদ্ভুত মিল। চক্রান্তকারী খুনিরা বঙ্গবন্ধুর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নিশুতি রাতে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত এবং বিয়োগান্তক ঘটনা সংঘটিত করে। সপরিবারে নিহত হন তিনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পর্দার অন্তরালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিআই-এর সংশ্লিষ্টতাও আমরা দেখিয়েছি। নিক্সন-কিসিঞ্জার যে তাদের ব্যক্তিগত পরাজয়ের প্রতিশোধ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারেন, আামি অন্তত এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিই না। সম্প্রতি প্রকাশিত ১৯৭১-এর ঘটনাবলিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সংবলিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিলের মতোই একদিন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মার্কিন ভূমিকা সংবলিত স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিলও যথাসময়ে প্রকাশিত হবে বলেই আমার বিশ^াস। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিগুলো তাদের চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

লেখক- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, মাসিক উত্তরণের প্রকাশক ও সম্পাদক

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ