Search
Close this search box.

বাস্তবতার ওপর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

বাস্তবতার ওপর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্বদেশ রায়

বেশ কিছু ব্যস্ততার কারণে লেখাটা লিখতে দেরি হয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরপরই দিল্লিতে বসে লেখাটা লেখার ইচ্ছে ছিল। কারণ, এই নিয়ে তিনবার হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর কাভার করেছি। তবে তারপরও এবারের সফরের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে একটি বাড়তি আকর্ষণ ছিল। কারণ, সফরের শুধু আগে থেকে নয়, ২০১০ সাল থেকে একটা বিষয় সবসময়ই বলে আসছি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অনেক বড় অর্জন, আর সে যুদ্ধের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের পরে গঙ্গা ও পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তাছাড়া পৃথিবীতে কোনও ঘটনার সর্বোচ্চ ইম্প্যাক্ট ২৫ বছরও থাকে না। তারপরে সেটা ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতায় অনেক গৌরবগাথা, অনেক দুঃখ ব্যথা থাকে, যাকে ঘিরে অনেক আবেগও থাকে। কিন্তু আবেগনির্ভর কোনও কিছুই শুধু তাদের বেশি আলোড়িত করে, যারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের আবেগ আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে একটি দেশের সম্পর্ক স্থায়ী হওয়া ও কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়।

এমনকি যদিও পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশ, তারপরও বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শুধু নয়, সব কালে সংস্কৃতি সমাজ ও মানুষকে একই বাঁধনে বেঁধেছে -রাষ্ট্রকে নয়। রাষ্ট্র আরও বেশি নির্মোহ ও যান্ত্রিক। তাই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক সবসময়ই শক্তিশালী হয় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ইস্যুতে। যেমন, যে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১২ বছর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে– সেই ভিয়েতনামের এখন অন্যতম অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পার্টনার আমেরিকা। ঠিকই একইভাবে পূর্ব ইউরোপের কাছের দেশ রাশিয়ার প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও আজ নিরাপত্তা ইস্যুতে ইউক্রেনের সব থেকে বড় বন্ধু আমেরিকা।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবার যখন ৫ সেপ্টেম্বর ভারত সফরে গেছেন, ওই সময়ে বেশ কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল যে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গতিশীল করার জন্যে দুই দেশ কাজ করবে। কারণ, কোভিডের সময় ভারত থেকে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সাপ্লাই বজায় থাকায় এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ সব থেকে প্রয়োজনীয়। কোনও দুটো দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি কাজ করে ওই দুই দেশের মানুষ যাতে পরস্পর পরস্পরের দেশকে চেনে। কারণ, যেকোনও দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করার বিষয়টি সম্পূর্ণ উদ্ভাবনী বিষয়। আর বিশেষত ভারত বা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এখনও সব অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এক্সপ্লোর হয়নি। অনেক নতুন কিছু এখানে সংযোগ হওয়ার সুযোগ আছে নতুন উদ্ভাবনী দিয়ে। সে কাজটির একটি বড় অংশ হবে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। যেমন, থাইল্যান্ডের সুপার মার্কেটে গত দশ বছরেই চীন ও ইন্দোনেশিয়াকে সরিয়ে দিয়ে চামড়া পণ্যের একটা বড় জায়গা নিয়ে নিয়েছে ভিয়েতনাম। আবার এর পাশাপাশি এই কোভিড পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে পূর্ব এশীয় দেশগুলো বিভিন্ন দেশের কয়েকটি সাবজেক্টের গ্রাজুয়েটদের দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য কোভিড পরবর্তী এই সময়ে ব্যবসা বাণিজ্য থেকে সবকিছুর ধরন বদলে গেছে। এ সময়ে পারস্পরিক যোগাযোগ ও নতুন জ্ঞানের প্রয়োজন অনেক বেশি। বাংলাদেশকেও ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে এমনটি ভাবতে হবে। আর এ কাজটি কখনোই সনাতনী কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে সম্ভব নয়।

যেমন, ভারত সরকার বলছে তেমনি বাংলাদেশও বলছে এই দুটি দেশের বন্ধুত্ব ভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে কি বাংলাদেশ ভিন্নমাত্রায় আছে? প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় অধিকাংশ ইংরেজি পত্রিকা দুই দিন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের নিউজ তাদের প্রধান শিরোনাম করেছিল। কিন্তু তারপরেও সত্য হলো, তার মাত্র তিনদিন পরেই উত্তর প্রদেশের অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নেতা এসব কিছুই জানে না। এমনকি একজন তরুণ চীন বিশেষজ্ঞ, যিনি রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে ভারতের বর্তমান সরকারি দলের সমর্থক, তাঁর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে কথা বলার সময়ে তিনি বলেন, তিনি গান্ধীজি বা জওয়াহেরলাল নেহরুকে নেতা মনে করেন না, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীকে রেসপেক্ট করেন একটা কারণে, তিনি পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি তার এই সম্মানবোধ দেখে, তাকে বলার চেষ্টা করলাম যে বাংলাদেশের মানুষও ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মান করেন। কারণ, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু কথা খুব বেশি এগোয়নি। দুই একটা কথা বলেই বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট নন। তার কাছে ১৯৭১-এর ইন্দিরা গান্ধীর বিষয়টি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যে দিল্লিতে মাঝে মাঝে হতে হয় না, তা নয়।

২০১৪ বা ১৫ সালের দিকে দিল্লির একটা ক্লাবে দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী, যিনি দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ এবং ভারতের বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী- তার সঙ্গে গল্প প্রসঙ্গে তিনি একপর্যায়ে আমার কাছে জানতে চান, আমাদের বাংলাদেশের ভাষা ও কলকাতার ভাষা এক কিনা? খুবই নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিয়েছিলাম। আর মনে মনে ভেবেছিলাম, আমি পান্ডব বর্জিত দেশের লোক হয়েও ভারতবর্ষের (পাকিস্তানসহ) প্রতিটি রাজ্যের ভাষার নাম অন্তত জানি আর তিনি চানক্যের স্বগোত্রীয় হয়েও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনও খোঁজ নেন না। অবশ্য পরক্ষণেই তা নিয়ে কোনও অভিমান বা দুঃখ ছিল না। কারণ, ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন পালাম বিমানবন্দরের পাশের গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণ দেন, ওই জনসভার ভারতীয় বড় পত্রিকাগুলোর এবং বিদেশি এজেন্সির নিউজগুলো খুবই মনোযোগের সঙ্গে এখন পড়ে দেখি অনেক রিপোর্টে একটি বিষয় আছে– দিল্লির ওই তীব্র শীতের ভোরে, দিল্লির বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা চিত্তরঞ্জন পার্ক (সি আর পার্ক) থেকে হাজার হাজার মানুষ তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে শেখ মুজিবের জনসভায় এসেছিল। এ কারণেই এখন বুঝি, বঙ্গবন্ধু সেদিন ইংরেজিতে ভাষণ দিতে গেলে জনসভা থেকে জোর দারি উঠেছিল বাংলায় ভাষণ দেবার।

অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এত বড় ঘটনাও কিন্তু ভারতের সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব মহল এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও দিল্লির বাঙালিপাড়া ছাড়া খুব একটা সে দেশের সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেনি। বিশেষ করে উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষাভাষি বলয় ও দক্ষিণ ভারতীয়দের সাধারণ মানুষের কাছে সেটা খুব একটা পৌঁছায়নি। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সে তাদের দেশের নেতাদের কথাও খুব একটা পৌঁছায় তা নয়। আমার ছোট ভাইয়ের মতো প্রীতিভাজন এক ভারতীয় সাংবাদিক যে সারা ভারত ঘুরেছে নিজের ইচ্ছে থেকেই- তার বক্তব্য হলো– ভারতের সাধারণ মানুষ সে দেশের তিন জন নেতার নাম জানে, এক, গান্ধী বুড়া, দুই, নেতাজী সুভাষ, তিন, ইন্দিরা গান্ধী। গান্ধীজি ও সুভাষ বোসের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধীকে চেনার কারণ মূলত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। তারা তাদের ইতিহাসে ও পাঠ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্থান দেয়নি সেভাবে। যাহোক, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এখন বাংলাদেশের যে জেনারেশন তারাও আমাদের মতো কোনও আবেগের মধ্যে নেই। তারা বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে। তাদের কাছে এখন পৃথিবীর সব দেশই সমান। তারা বোঝে রাষ্ট্র একটি মেশিনারিজ। এর সঙ্গে কোনও রক্ত, ধর্ম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। তারা বোঝে সৌদি আরব আমাদের এখান থেকে লেবার নেয় সব থেকে কম দামে পায় এজন্য। ধর্মের কারণে নয়। আর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশের সাংবাদিকতায় ভারতীয় সাংবাদিকদের আধিপত্য, তার কারণ যোগ্যতা- ধর্ম নয়। আবার আল জাজিরায় নিয়োগ পেতে ভারতীয় সাংবাদিকরা ইউরোপীয় সাংবাদিকদের কাছে যোগ্যতায় হেরে গেছে- তাই সেখানে ইউরোপীয়দের আধিপত্য। আবার আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক এস এম আলী পূর্ব এশীয় দেশ থাইল্যান্ডের ‘ব্যাংকক পোস্টে’ আমেরিকানদের হারিয়ে দিয়ে সম্পাদক হয়েছিলেন যোগ্যতার কারণে।

তাই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক, ভিন্ন রাষ্ট্রে কর্মক্ষেত্র ও বাণিজ্য সবই নির্ভর করে যোগ্যতা বা দক্ষতার ওপর। অন্য কোনও কিছুই এখানে বাস্তবে কাজে আসে না বলা চলে। ভারত ও বাংলাদেশ যে সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে, এবং দুই দেশ যে সময়ে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমি পার্টনারশিপে একমত হতে যাচ্ছে, এ সময়ে প্রত্যেকেরই স্বার্থ রক্ষার জন্যে অনেক বেশি বাস্তব হতে হবে। এই বাস্তবতার প্রথম শর্ত হলো, দুই দেশের নতুন প্রজন্ম যারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেবে বা একটা শক্ত ভিতের ওপর ভবিষ্যতে দাঁড় করাবে- তারা যাতে দুটো দেশ সম্পর্কে জানে সে কাজটি আগে করতে হবে। কারণ, তারা যে নতুন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এক্সপ্লোর করবে সেগুলোই প্রকৃত অর্থে ভবিষ্যতে দুই দেশের মানুষের স্বার্থে অর্থনৈতিক সম্পর্কের সুফল দেবে। তাছাড়া রাষ্ট্রের সহায়তায় যে ব্যবসায়ীরা দুই দেশে ব্যবসা করবে ওই ব্যবসাতে শুধু ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবে সাধারণ মানুষ এর সুফল খুব কম পাবে। কারণ, এ মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশ এই দুই দেশেই কিন্তু প্রকৃত ক্যাপিটালইজম বা মার্কেট ইকোনমি কাজ করছে না- বাস্তবে দুই দেশেই ক্রোনিক্যাপিটালইজম কাজ করছে বা সরকারি আনুকূল্যে কিছু ব্যবসায়ী তাদের স্বার্থ রক্ষার বা নিজেরা ফুলেফেঁপে ওঠার ব্যবসা করছে। এখানে দেশের স্বার্থ বা জাতীয় স্বার্থ খুবই কম। এবং এসব ব্যবসায়ী অর্থনীতিতে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলেও এই ধারার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। কেবল ‘ক’ এর জায়গায় ‘খ’ আসবে এটুকুই।

তাই প্রকৃত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে হবে এই সরকারি আনুকূল্যের ব্যবসায়ীদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে। আর সেজন্য প্রয়োজন যাতে দুই দেশের মানুষ দুই দেশকে জানে বিশেষ করে উত্তর ভারতের মানুষ এবং দক্ষিণ ভারতের মানুষ বাংলাদেশকে জানে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়– সে কাজ করা। আর সে কাজ করতে হলে বাংলাদেশকে হিন্দি ভাষায় ও দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্য বিশেষ করে মালায়ালম, তামিল ও তেলেগু ভাষায় ঢুকতে হবে।

যেমন, ইউরোপের ইংরেজি বলয় ও আমেরিকা ছাড়া আমরা দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এমনকি চীনেও ঢুকতে পারছি না কিন্তু ভাষার কারণে। চীনের সঙ্গে আমাদের যতই সম্পর্ক হোক না কেন, এই অস্ত্র কেনা আর সরকারি করপোরেশনের কনস্ট্রাকশনের মধ্যেই কিন্তু থেকে যাবে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য। ইউরোপ, আমেরিকা কিন্তু চীনে ঢুকবে বলে ম্যান্ডারিন শিখছে এখান থেকে ২৫ বছর আগের থেকে। নব্বইয়ের দশকে গার্ডিয়ানে, নিউ ইয়র্ক টাইমসে বিজ্ঞাপন থাকতো, কম খরচে ম্যান্ডারিন শেখার ইনস্টিটিউটের।

অন্য আরেকটি দিক হলো, বাংলাদেশে অর্থনীতিতে প্রফেশনালইজম গড়ে ওঠার সুযোগ কম পেয়েছে। কারণ, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ভারতের বিজনেস ক্যাপিটাল বোম্বেতে সরকারি আনুকূল্যের ব্যবসায়ী ছাড়াও কিন্তু বিশাল সংখ্যক প্রফেশনাল ব্যবসায়ী শ্রেণি শত শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে। ঠিকই একই বিষয় দেখা যায় দক্ষিণ ভারতে। সেখানেও শত শত বছর ধরে একটি প্রফেশনাল ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। বোম্বের এসব ব্যবসায়ীর মুখ আরব সাগরের তীর থেকে সারা পৃথিবীতে। অন্যদিকে দক্ষিণের বড় অংশের মুখ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্য মহাদেশেও। এদের একটি অংশের মুখ বাংলাদেশের দিকে ঘুরাতে গেলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী শ্রেণিতে যাতে প্রফেশনালিজম গড়ে ওঠে সে পরিবেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব ভারত। আমাদের অনেকের ধারণা, দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে আমরা স্বাভাবিকভাবে বাজার পেয়ে যাবো। যেহেতু তাদের যোগাযোগ আমাদের ওপর নির্ভরশীল। মিয়ানমারের নতুন সমুদ্রবন্দর, বাজেট এয়ার এবং দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের সাম্প্রতিক অবকাঠামো নির্মাণ এই ধারণার বাইরে বিষয়টি নিয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

ভারতের সঙ্গে এই অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টির বাইরে আর যে বাস্তব বিষয়টি রয়েছে তা ৫৪টা যৌথ নদীর পানি বণ্টনের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, গত দশ বছরের বেশি সবার ফোকাস শুধু তিস্তা। যৌথ নদী কমিশন ওভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। পাকিস্তান আমল থেকে এই ৫৪ নদীর পানির সমস্যা সমাধানে যে বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা কাজ করতেন তারাও এখন আর নেই। দুই দেশেই অবসরে চলে গেছেন তারা। এমনকি দুই দেশের মিডিয়া দেখলেও মনে হয় আগে দুই দেশের মিডিয়ার সাংবাদিকরা যেভাবে এই যৌথ নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি জানতেন এবং বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে নানান প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত ও বিশেষজ্ঞ মতামত সামনে আনতেন, সেখান থেকেও মিডিয়া সরে গেছে। কেন এ বিষয়টি ঘটেছে সে প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। আলাদা লেখার ইচ্ছে রইলো। তবে ভারত ও বাংলাদেশের এই ৫৪ নদীর পানির সমস্যার প্রকৃত সমাধান ছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক বাস্তবতায় আসবে না। আর নদীর পানি বণ্টনের বিষয়কে রাজনৈতিক না করে ওপর থেকে নিচের দিকে বয়ে আসা এই মিষ্ট পানির প্রতিটি ফোঁটা যাতে ফসল উৎপাদনে কাজে লাগে সেদিক দেখতে হবে। সেজন্য বাস্তবভিত্তিক অবকাঠামো চিন্তা করতে হবে, যাতে পানির একটি ফোঁটাও নষ্ট না হয়, শুধু কে কত কিউসেক পানি পেলো এখানে চিন্তা আটকে থাকলে কোনও বাস্তব সমাধান হবে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্যে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ