প্রণব কুমার পান্ডে
বঙ্গবন্ধু চারিত্রিকভাবে ছিলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সত্যের অনুসারী এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে বদ্ধপরিকর। সেই ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় একবার জেলা শিক্ষা অফিসারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে তর্ক করেছিলেন। পরবর্তীতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিল দেশবাসী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয় হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, ঠিক সেই সময় বাংলার মানুষ কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই জানতেন এই হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলার মাটি ও মানুষকে রক্ষা করতে হলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হবে।
আর এই কারণেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি এক মহাকাব্যিক বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। একটি অলিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি যেভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের দৃশ্যপট রচনা করেছিলেন তা ইতিহাসে সত্যিই বিরল। সেই দিন বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তাঁকে গ্রেফতার করে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতি রহিত করতো পাকিস্তানি জান্তা। কিন্তু, পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে চিনলেও তার ভেতরের যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সেটা চিনতে কিছুটা হলেও ভুল করেছিলেন। আর এই কারণেই বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাঁর সেই বক্তব্য শুধু বাংলাদেশের জনগণকেই নয়, বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করেছিল। এটি এমন এক ধরনের আবেগময় ভাষণ ছিল সে আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার লাখো লাখো আবাল বৃদ্ধ বনিতা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। কারণ, মাত্র নয় মাসে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে এরকম উদাহরণ পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে।
অনেকের মনে এতক্ষণ একটি প্রশ্ন জেগেছে যে আজকের লেখার শিরোনামের সঙ্গে এই বিষয়ের অবতারণা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আমি মনে করি এটি সত্যিই যুক্তিযুক্ত। ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করা সব নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই ধরনের ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন অন্যরকম নেতৃত্ব, যা হবে নির্ভীক, বলিষ্ঠ এবং দূরদর্শী। বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। প্রথমদিকে সব ভালোই চলছিল। কিন্তু যখনই তাঁর এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম পাকিস্তানপন্থীদের স্বার্থে আঘাত হানে, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর ভয়াল রাতে তাঁকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুরোটাই বাধাগ্রস্ত হয়।
এরপরে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করে দলকে সংগঠিত করে ক্ষমতায় নিয়ে যান। গত ১২ বছর শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ শাসন করছেন তাতে স্পষ্টতই তার বাবার রাজনৈতিক গুণাবলি তাঁর নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে কোনও তর্কের অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধুর যেমন বাঙালির ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ছিল অপরিসীম ভালোবাসা, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনার রয়েছে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু যেমন নীতির সঙ্গে কখনোই আপস করেননি, ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাও নীতির কাছে আপস না করে কঠোরভাবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবো এবং আশা করছি ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বে উন্নীত হবো। গত এক দশকে উন্নয়ন এমনি এমনি হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে হয়েছে। তিনি চেষ্টা করেছেন উন্নয়নের সব মাত্রায় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, যাতে সার্বিকভাবে উন্নয়ন সূচকে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা যেমন এশিয়ান টাইগার হয়েছি, ঠিক তেমনি সামাজিক সূচকে গত এক দশকের আমাদের উন্নয়ন পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করেছি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাফল্যের কারণে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘এসডিজি প্রগ্রেস ওয়ার্ড’-এ ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ অধিবেশনে।
বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১২ বছর ধরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। এটি সত্যিই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। পিতামাতার আদর্শ সাধারণত সন্তানদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়- এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শেখ হাসিনার মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবারগুলোতে এই বিষয়টি সব সময় স্বাভাবিক হতে দেখা যায়নি। আমরা দেখেছি কীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে সন্তানরা বিভিন্নভাবে দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। অবশ্যই কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, সেসব সন্তানকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে হয়তো পিতামাতা ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক, যখন কেউ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখন তাঁর উচিত নিজের সম্মান রক্ষার্থে এবং দেশের মানুষের কথা ভেবে নিজের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি, অনেকেই তাঁদের সন্তানদের একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি, আবার পাশাপাশি নিজেদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকের সন্তানদের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
সেই জায়গা থেকে বিচার করলে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো শেখ হাসিনার চরিত্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। শেখ হাসিনা তাঁর বাবার আদর্শকে শুধু লালনই করেননি, তাঁর অপূর্ণ স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ অবশ্যই সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক, বঙ্গবন্ধু যেমন বিভিন্ন সময়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সেভাবে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। কখনও বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, আবার কখনও বা মৌলবাদের হামলার শিকার হয়েছেন। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় তিনি প্রতিবারই অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।
তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এখন সবাই বাংলাদেশকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। ১২ বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে শেখ হাসিনা আঞ্চলিক নেত্রী থেকে বিশ্বনেতৃত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন। বড় বড় দেশের রাজনৈতিক নেতারা শেখ হাসিনার কাছে প্রায়ই জানতে চান বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় উন্নয়নের মূলমন্ত্র। শেখ হাসিনা বারবার একই কথা বলেছেন যে জনগণকে ভালোবেসে, তাদের কথা চিন্তা করে, এবং সততার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করলে দেশের উন্নয়ন হবে এটিই স্বাভাবিক। এবং এই কারণেই তিনি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সোনার বাংলার জনগণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তাঁর লড়াই চলমান রয়েছে। আবার এটিও ঠিক, তাঁর আশপাশে, এমনকি তাঁর দলেও এখনও কিছু অপশক্তির অন্তর্ভুক্তি হয়েছে, যারা সব সময় চেষ্টা করছে উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে।
অতএব, এই মানুষগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহের কিছু মানুষ, যাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজের খাবার শেয়ার করতেন। সেই খন্দকার মোশতাক গংয়ের প্রেতাত্মারা আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে কারা তাঁর ভালো চায় এবং কারা তার খারাপ চায়? এই মানুষগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। পরিশেষে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দৃশ্যমানতা পিতা-কন্যার সম্পর্কের খাতিরে স্বাভাবিক হলেও বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়