সব্যসাচী দাশ
বাংলাভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ভালোবাসা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। পাকিস্তান জন্মের পর থেকে নিজস্ব্য সংস্কৃতি রক্ষায় অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছেন এই মহান বাঙালি। বিশেষ করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ঢাকায় একটি স্থায়ী ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করেন আবদুল জব্বার খান, ডক্টর আবদুস সাদেক, নূরুজ্জামান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে একটি পরিকল্পনা পেশ করতে বললে তারা তা করেন। ১৯৫৬ সালে সরকার প্রদেশে চলচ্চিত্র শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। পরের বছর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে এখানে একটি সংস্থা গঠনকল্পে ১ কোটি টাকা বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়। প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপনের পর পরিষদের সদস্যরা কিছু সংশোধনী আনেন। পরে সংশোধিত বিলটি বিনা বাধায় আইন পরিষদে পাস হয়। যাত্রা করে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, যা আজকের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসি নামে পরিচিত। মূলত দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অদ্বিতীয়।
সত্তরের দশক থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামটি একটি চ্যালেঞ্জে রূপান্তরিত হয়। অবশেষে এই চ্যালেঞ্জের কাছে হেরে গিয়ে বাংলাদেশের জয় হয় আর এই জয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপের দাড়িয়ে দেশ পূর্ণগঠন করেন তিনি। তখন অন্যসব কিছুর মতো ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয় সংস্থা’র নবযাত্রা শুরু হয় তাঁর একক চেষ্টায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নবতম সংযোজন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই এ প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং ১৯৭২ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাহিনীচিত্র নির্মাণ। এসবের মধ্যে রয়েছে ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ধীরে বহে মেঘনা, আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল ও সংগ্রাম। উল্লেখ্য, সংগ্রাম ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। বঙ্গবন্ধুর আমলেই নির্মিত হয় কালজয়ী উপন্যাসভিত্তিক চলচ্চিত্র তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)। এছাড়া ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ঈশা খাঁ (১৯৭৪), লালন ফকির (১৯৭২)। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পে যে মানুষটির এতো এতো অবদান সেই মানুষটিকে কিভাবে চলচ্চিত্র ধারণ করলো সেটা অবশ্যই আলোচ্য বিষয়।
চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু যে মাপের ব্যাক্তিত্ব ছিল সেই মাপের প্রভাব বিস্তারকারি চলচ্চিত্র এখনও হয়নি বলে অনেকে বিশ^াস করেন। তবে তাঁকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা কিন্তু চলছে। বিশেষ করে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ সময়কাল বিধৃত হয়েছে দেশী-বিদেশী মুভি ক্যামেরায়। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, প্রতিবাদ, জনসভা, সংবর্ধনা, অসহযোগ আন্দোলন, সাক্ষাৎকার, ৭ মার্চের ভাষণ চলচ্চিত্রের উপাদান হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রদর্শন হয়। পরবর্তী সময়ে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে এসব ব্যবহৃত হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশে আগমন, দিল্লি থেকে শুরু করে জাপান, রাশিয়া, মিসর, ইরাকে বঙ্গবন্ধুর সফর নিয়ে একাধিক প্রামাণ্যচিত্র। রয়েছে ‘অসমাপ্ত মহাকাব্য’, ‘চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’, ‘স্বাধীনতা কী করে আমাদের হলো’ (৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অবলম্বনে), ‘বঙ্গবন্ধু ফরএভার ইন আওয়ার হার্টস’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ (বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতিবিষয়ক তথ্যচিত্র), ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক একটি প্রামাণ্যচিত্র), ‘সোনালী দিনগুলো’ (বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর), ‘ওদের ক্ষমা নেই’ ও ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’। এছাড়া উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে রহমান, ‘দ্য ফাদার অব বেঙ্গল’, ‘বাংলাদেশ’, ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’, ‘দ্য স্পিচ’, ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ ‘টুঙ্গী পাড়ার মিয়া ভাই’ ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ এছাড়া তানভীর মোকাম্মেলের ‘মধুমতি পাড়ের ছেলেটি’ মুক্তির অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এযাবতকালের সব থেকে বড় ক্যানভাসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়। ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগল ‘মজিব: একটি জাতির রূপকার’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তবে এখনও মুক্তির দিন ঠিক হয়নি। বাংলাভাষাভাষি সব মানুষ অধির অপেক্ষায় এই সিনেমার। সত্যি কথা বলতে শেখ মুজিবুর রহমান যে শ্রেণীর মানুষ ছিলেন তাকে ক্যানভাসে ধারণ করা সব নির্মাতার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। সেই বিবেচনায় অনেক নির্মাতা তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে ঘাবরে যান বলে অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মনে করেন। তবে যাই হোক শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন একটা ভূখন্ডের ইতিহাস। তার রেখে যাওয়া প্রতিটি স্মৃতি এক একটি অনন্তকালের চলচ্চিত্র।