করজালের বাইরে রয়েছে দেশের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক ইউনিট। বর্তমানে দেশে সর্বমোট অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট রয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখেরও বেশি। তার মধ্যে ৬২ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিটের সংখ্যা। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় নিবন্ধিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার। আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে সরকারের কর আহরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে বিশ্বের অন্যতম নিম্ন কর-জিডিপি আহরণের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর ছাড়াও সেলফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে কেনাকাটা, হোটেলে খাওয়া, সিনেমা দেখাসহ দৈনন্দিন লেনদেনে ভোক্তা ও গ্রাহকরা কোনো না কোনোভাবে করজালের আওতায় রয়েছে। কিন্তু এখনো করজালের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যমতে দেশে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ২১৪টি। তার মধ্যে ৩৯ লাখ গ্রামাঞ্চলে রয়েছে। আর শহরে রয়েছে ২৩ লাখ। তার মধ্যে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) বা ভ্যাট (মূসক) নিবন্ধনধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ ৫৭ হাজার। আর স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্যে ভ্যাট পরিশোধকারী হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আছে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের ৯ শতাংশের কিছু কম। অর্থাৎ ৯০ শতাংশেরও বেশি স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের কোনো ভ্যাট নিবন্ধন নেই। স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট বলতে প্রধানত একটি স্থায়ী জমিতে স্থায়ী কাঠামোর ওপর গঠন করা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়।
সূত্র জানায়, এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিটগুলোর সিংহভাগ এখনো করজালের বাইরে রয়েছে। এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হলে কর-রাজস্ব আহরণের জন্য ঘুরতে হবে না। এজন্য জনশক্তি না বাড়িয়ে দক্ষতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি। মূসক আইনে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিয়োজিত প্রতিটি ইউনিটেরই মূসক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এনবিআর বার্ষিক টার্নওভারের ওপর ওসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট পরিশোধের হার নির্ধারণ করে। তবে গত ৯ জানুয়ারি জারি করা ভ্যাট অধ্যাদেশে বলা হয়, যদি কোনো ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার ৩০ লাখ টাকার নিচে হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। যদি তা ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার মধ্যে হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। আর যদি ৫০ লাখ টাকার বেশি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের জুয়েলারি শিল্পের বড় একটি অংশ এখনো ভ্যাট নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সদস্য। তার মধ্যে মাত্র আট হাজার প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে। আর সেগুলোর মধ্যে মাত্র এক হাজার প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন করা হয়েছে। যদিও ভ্যাট আইনে ভ্যাট নিবন্ধনযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছু পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে বার্ষিক টার্নওভার নির্বিশেষে এবং দেশের সব সুপার শপ ও শপিংমলসহ সিটি করপোরেশন ও জেলা শহরের সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
এদিকে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বড়। আর দেশের মোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৃহদংশই করজালের বাইরে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সরকারি কোনো লাইসেন্স বা নিবন্ধন নেই এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগ কাঠামো বা আইনি কোনো সুরক্ষা নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আওতাভুক্ত ধরা হয়। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশে কর্মরত শ্রমিকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে মাত্র ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ কর্মজীবী। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক ৮৪ শতাংশ। তাদের মধ্যে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে। শতাংশের হিসাবে ওই হার ৪৫ শতাংশ আর শিল্পে ৩৮ শতাঙশ ও সেবা খাতে ১৭ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চেনধুরী জানান, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুয়েলারি খাতে প্রায় শতকোটি টাকা ভ্যাট আহরণ হয়েছে। যে কারণে দেশের সব জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বা সেলস ডাটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) স্থাপনের জন্য বাজুস থেকে সব জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন বা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। নিবন্ধনের বাইরে থাকা সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসবে এনবিআর। সেজন্য ফেব্রুয়ারিকে ভ্যাট কমিশনারদের জন্য নিবন্ধনের মাস এবং মার্চকে এনবিআরের জন্য নিবন্ধনের মাস ঘোষণা করা হয়েছে।
