গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে পাথরের চাহিদাও কমে গেছে। এ কারণে প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে পাথর আমদানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। এদিকে আমদানি মূল্য বেশি হওয়ার কারণে পাথর আমদানিতে আগ্রহ হারিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জানা যায়, দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি হয়। এক সময় বহুজাতিক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হলেও এখন কেবল পাথর আমদানি নির্ভর বন্দর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে নানা সংকটের কারণে সম্ভাবনাময় বন্দরটি বাণিজ্য ঘাটতির ফলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। আমদানি-রপ্তানি নেমেছে অর্ধেকের নিচে। সমপ্রতি এই বন্দর দিয়ে স্লট বুকিংয়ের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়কে কেন্দ্র করে ভুটান থেকে পাথর আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে দাম বেশি হওয়ায় ভারত থেকে পাথর আমদানি কমেছে। এতে এক সময়ের কর্মচঞ্চল বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, বেকার হয়ে পড়ছেন বন্দর সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানি-রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ীসহ পাথর শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ভুটানের পাথর গুনগত মানে ভালো হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি দেশটির প্রতি। এরমধ্যে আবার ভালো মানের পাথর আমদানিতে ভুটানের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন ডিউটি ছাড় রয়েছে। এজন্য ভারতের চেয়ে কম খরচে আমদানি করা যায় ভুটানের পাথর। তবে ২০২৩ সালে ভারতের ফুলবাড়ি স্থলবন্দরের ট্রাকচালক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বাংলাদেশে রপ্তানি করা ভুটানের পাথরের প্রতিটি ট্রাকের বিপরীতে স্লট বুকিং বাবদ ৩০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাবান্ধা বন্দরের ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। সমপ্রতি ভারতের ফুলবাড়ির ট্রাকচালক ও ব্যবসায়ীরা ওই স্লট বুকিং নিয়ে ফের সরব হয়ে উঠেন। অনশনসহ আন্দোলন শুরু করেন। তাদের দাবির মুখে আবারো রাজ্য সরকার ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাকের ওপর স্লট বুকিং চার্জ চাপিয়ে দেয়। এতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে যায় ভুটান থেকে পাথর আমদানি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি মূল্যের তুলনায় দেশের বাজারে দাম কমে যাওয়ায় তারা পাথর আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি লোকসান এড়াতে অনেক ব্যবসায়ী পাথর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর ভোমরা স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে যত ধরনের পণ্য আমদানি হয়ে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে পাথর। দেশের বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভোমরা থেকে পাথর ক্রয় করে থাকে। ভোমরা শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ বন্দর দিয়ে ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৫ টন পাথর আমদানি করা হয়েছিল। যার আমদানি মূল্য ৪৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর আগে গত অর্থবছরের একই সময়ে পাথর আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৮৪ টন, যার আমদানি মূল্য ছিল ৫৯ কোটি ৪ লাখ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি কমেছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৮৯ টন। এদিকে, সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পাথরের আমদানি গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যার ফলে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দুই হাজার শ্রমিক বিপাকে পড়েছেন। পাথরবাহী ট্রাকগুলোতে আবর্জনা ও কাদা আসায় আমদানিকারকদের প্রতি ট্রাকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। এই লোকসান কমাতে আমদানিকারকরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে, যাতে মাটি ও বালির ওজন বাদ দেয়া যায়। আমদানিকারকরা বলছেন, ভারত থেকে পাথর আমদানির প্রবাহ যেমনটা আশা করা হয়েছিল, তেমনটি হচ্ছে না। পূর্বে তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ১ হাজার গাড়ি আমদানি-রফতানি হলেও বর্তমানে পাথরের সঙ্গে মাটির সংমিশ্রণ জনিত কারণে আমদানি কমে গেছে এবং এর ফলস্বরূপ প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের আয় কমেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, গত মাসে তামাবিল স্থলবন্দর থেকে প্রায় দুই কোটি ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৬ শত ৩৮ টাকা রাজস্ব এসেছে, তবে বর্তমানে তিন থেকে চার শত গাড়ির মাধ্যমে প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকার রাজস্ব আসছে। এদিকে, বুড়িমারী স্থল বন্দর দিয়ে ভারত, ভুটান থেকে রপ্তানিযোগ্য দুই প্রকার পাথরের দাম পুননির্ধারণের দাবিতে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করে কাজ না হওয়ায় আমদানিকারকেরা পাথর আমদানি বন্ধ রাখেন। এতে প্রায় একমাস বন্ধ থকে পাথর আমদানি। পরে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের সমঝোতা বৈঠক শেষে সম্প্রতি পুনরায় পাথর আমদানি শুরু হয়েছে। আমদানিকারদের সূত্রে জানা গেছে, কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশে পাথরের নির্মাণকাজ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় বেশি দামে পাথর আমদানি করে ক্ষতির মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। লোকসান থেকে বাঁচতে পাথরভেদে দাম প্রতি মেট্রিক টন ২ থেকে ৩ ডলার কমানোর প্রস্তাব দিয়ে ওই দুই দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনকে কয়েকদফা চিঠি দেয় আমদানিকারকরা। তবে রপ্তানিকারক ও সরকার কোনোপ্রকার ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাথর আমদানি বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষতির মুখে পরে দুই উভয় পক্ষ। কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয় উভয় দেশের সরকার। বুড়িমারী স্থলবন্দর পাথর আমদানিতে পাথরের যৌক্তিক দর ও বাজার মনিটরিং করতে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বুড়িমারী স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ও বুড়িমারী স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের একটি প্রতিনিধি প্রতিনিধি দল ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরে গিয়ে পাথর আমদানি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন। ফলে ২২ দিন বন্ধ থাকার পর পাথর আমদানি পুনরায় শুরু করা হয়। দেশে পাথরের মূল্য কমে যাওয়া প্রসঙ্গে আমদানিকারকরা জানান, ?সরকারি বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে আছে। ফলে পাথরের চাহিদা কমে গিয়ে দামও নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আপাতত পাথর আমদানি বন্ধ রাখছেন অনেকে। পাথর আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, আমদানির পরিমাণ ৪ ভাগ থেকে কমে এখন ১ ভাগে নেমে এসেছে। এ সংকট দূর করতে তারা সরকারকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।
