বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডা। এই ঘটনাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে নির্ধারিত খনিজসম্পদ-সংক্রান্ত ঐতিহাসিক চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে।
এই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের মধ্যে আরও বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিবিসির সাংবাদিক জেরেমি বোয়েন মনে করেন, ট্রাম্প মূলত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করছেন। ওই ঘটনার পর ট্রাম্প এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে লেখেন, “যখন জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন তিনি ফিরে আসতে পারেন।”
ইউক্রেনের বিশ্লেষক ভ্লাদিমির ফেসেঙ্ক বলেছেন, এখনো পরিষ্কার নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রতি কী ধরনের মনোভাব নেবে। তবে পরিস্থিতি যে ইউক্রেনের পক্ষে ভালো কিছু বয়ে আনবে না, তা নিশ্চিত করাই শ্রেয়। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
ন্যাটো সংকটে?
ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রশাসনের সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া হতো। কিন্তু মাত্র একটি বৈঠকের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প এই নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন। বৈঠকের দিন ইউক্রেনের খনিজসম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাকবিতণ্ডার জেরে তা বাতিল হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে সম্পর্ক আগে থেকেই শীতল ছিল। হোয়াইট হাউসে হওয়া ওই বৈঠকে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে স্বৈরশাসক বলে আখ্যা দেন এবং অভিযোগ করেন যে, ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ শুরু করেছে।
বৈঠকের একপর্যায়ে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে জেলেনস্কিকে দুপুরের খাবার না দিয়েই বেরিয়ে যেতে বলেন। এই ঘটনা বাইডেন প্রশাসনের গড়ে তোলা ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তা নীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা কি ঝুঁকিতে?
মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ন্যাটোর ১৯৪৯ সালের চুক্তি মেনে না চলেন, তবে ইউক্রেন একা হয়ে পড়বে। ওই চুক্তি অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে তা পুরো জোটের ওপর হামলা বলে বিবেচিত হবে এবং অন্যান্য সদস্য দেশ তাকে সহায়তা করবে।
ইউক্রেনকে বাদ দিয়েই কি শান্তি আলোচনা?
২০২২ সালে রাশিয়ার হামলার পর থেকেই ট্রাম্প ইউক্রেনকে মার্কিন সহায়তা দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বরাবরই বলে এসেছেন, ক্ষমতায় গেলে দ্রুত যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন। তবে কীভাবে তা করবেন, সে বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলেননি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেন এবং ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ইউক্রেনকে বাদ দিয়েই শান্তি আলোচনার পরিকল্পনা করছেন। ইউক্রেন এবং ইউরোপের দেশগুলো এতে অসন্তুষ্ট হলেও ট্রাম্প এসব আপত্তি উপেক্ষা করেছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী?
জেলেনস্কির যুক্তরাষ্ট্র সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ওয়াশিংটনের সমর্থন বজায় রাখা। কিন্তু তার বদলে সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে গেছে। ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অভিযোগ করেন যে, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তার জন্য যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে না।
এই ঘটনার ফলে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ‘দ্য কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে এবং ইউক্রেনকে বিপদের মুখে ফেলেছে।”
সাংবাদিক মুস্তাফা নাইয়েম বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ইউক্রেন তাদের কূটনৈতিক কৌশলে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে জেলেনস্কি তার অবস্থানে অনড় ছিলেন এবং মর্যাদার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।”
ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী?
যদি ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউক্রেন কতদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষক মাইকোলা বিয়েলিয়েস্কোভ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন করা সম্ভব, তা বলা কঠিন। কিন্তু আমাদের জন্য মার্কিন সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “গতকাল ছিল ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সবচেয়ে অন্ধকার দিন।”