ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ আমেরিকার আদি ফসল ক্যাপসিকাম, যা বেল মরিচ, মিষ্টি মরিচ কিংবা সবুজ মরিচ নামে পরিচিত। যদি সরকারি নীতিগত সহায়তা ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তবে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এটি নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।
একসময় বরিশাল শস্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ‘শস্যভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানকার ধান, তরমুজ ও সবজি সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। এমনকি বানারীপাড়ার বালাম চালের সুখ্যাতিও বিদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তবে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে ক্যাপসিকাম চাষ। বিশেষ করে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ক্যাপসিকামের চাষ হচ্ছে, এবং কৃষকরাও আশানুরূপ ফলন পাচ্ছেন।
ক্যাপসিকাম চাষে দক্ষিণাঞ্চলের অগ্রগতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগে ৭৬ হেক্টর জমিতে ১,৩৫৩ মেট্রিক টন ক্যাপসিকাম উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীতে ২ হেক্টর এবং ভোলায় ৭৪ হেক্টর জমিতে এ ফসলের চাষ হয়েছে, যেখানে প্রতি হেক্টরে গড়ে ৭.৮ মেট্রিক টন ফলন হয়েছে।
বরিশাল, পিরোজপুর ও বরগুনায়ও ক্যাপসিকামের চাষ শুরু হয়েছে, যা এখনো কৃষি বিভাগের আনুষ্ঠানিক জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বরিশালের লড়াইপুর চরে কয়েক একরজুড়ে ক্যাপসিকামের চাষ হচ্ছে, যেখানে ইতোমধ্যে দুইবার ফলন সংগ্রহ করা হয়েছে এবং গাছগুলোতে আরও ক্যাপসিকাম বড় হচ্ছে।
কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ
ভোলার মাঝের চরে প্রায় এক যুগ ধরে ক্যাপসিকাম চাষ করছেন চাষি মো. ইব্রাহিম। তার মতে, চরাঞ্চলে প্রচুর রোদ ও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের কারণে ক্যাপসিকামের ভালো ফলন হয়। বরিশালের লড়াইপুর চরে তিনি তিন বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করে দুইবার ফসল সংগ্রহ করেছেন, এবং আরও ২-৩ বার ফসল তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে ক্যাপসিকাম চাষ ব্যয়বহুল। চাষি মুনসুর আলী মিয়া জানান, এক কেজি বীজ কিনতে ২.৮ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয় এবং প্রতি বিঘা জমিতে মৌসুমে প্রায় ৬-৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়। বাজারে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা গেলে চাষ আরও লাভজনক হবে।
কৃষক আলামিন হোসেনের অভিযোগ, কৃষি অফিস থেকে কোনো সহায়তা পান না তারা। নিজেদের টাকায় জমি লিজ নিয়ে চাষ করে উৎপাদিত ক্যাপসিকাম রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। সরকার যদি স্বল্প সুদে ঋণ ও বীজ সরবরাহ করে, তাহলে ক্যাপসিকামের চাষ আরও বিস্তৃত হবে। বর্তমানে কৃষকরা প্রতি কেজি ক্যাপসিকাম ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি করলেও বাজারে তা ১৫০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়।
বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বিভিন্ন উপজেলাতেও ক্যাপসিকামের চাষ বাড়ছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চাষি আবুল সরদার জানান, তার এলাকায় তরমুজ ও বাঙ্গির চাষ হলেও বাজারের অনিশ্চয়তা থাকে। তাই তিনি ক্যাপসিকাম চাষ শুরু করেছেন এবং দ্রুত বিক্রিও করতে পারছেন। চলতি বছর তিনি দুই একর জমিতে চাষ করেছেন এবং আগামীতে এর পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন।
ক্যাপসিকামের স্বাস্থ্য উপকারিতা
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাহাবুব আলম মীর্জা জানান, ক্যাপসিকাম পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং এটি সবুজ, লাল, হলুদ ও কমলা রঙের হয়ে থাকে। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ ও কে রয়েছে।
- ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
- ভিটামিন এ চোখের জন্য উপকারী।
- ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
এছাড়া, ক্যাপসিকাম অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা দেহের কোষগুলোকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকাল থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- ওজন কমাতে সহায়ক: কম ক্যালোরিযুক্ত ও ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ: এতে থাকা পটাশিয়াম ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- হজমের উন্নতি: ফাইবার থাকার কারণে এটি হজমে সহায়ক এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
- ত্বক ও চুলের যত্ন: ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বক উজ্জ্বল রাখে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
- ক্যানসার প্রতিরোধ: এতে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
- মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি: মানসিক চাপ কমিয়ে মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ডা. মাহাবুব আলম মীর্জা বলেন, নিয়মিত খাদ্যতালিকায় ক্যাপসিকাম অন্তর্ভুক্ত করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি সালাদ, রান্না করা খাবার কিংবা কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যেতে পারে।
উপসংহার
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উদ্যান বিশেষজ্ঞ জিএমএম কবীর খান মনে করেন, দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাপসিকাম চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এবং কৃষকরাও ভালো ফলন পাচ্ছেন। সরকারি সহায়তা ও বাজারমূল্য নিশ্চিত করা গেলে এটি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।