জাফর ওয়াজেদ
ছিলেন তিনি ক্ষণজন্মা পুরুষ। হিমালয়ের চেয়ে উঁচু যাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহস। পরাক্রম, পরাভব না মানা সময়কে সঙ্গে নিয়ে অনিরুদ্ধ অতিক্রম করেছেন। আর সেই বরাভয় কাঁধে নিয়ে এগিয়েছেন মানবমুক্তির অমোঘ মন্ত্রসহকারে। সব প্রতিবন্ধকতা, সব বাধা, সব দুঃসহ যাতনা দূরীভূত করার সংগ্রামকে করেছেন ত্বরান্বিত। হতশ্রী, পশ্চাৎপদ অসহায়, শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত নিজ জাতিকে করে তুলেছিলেন বীর যোদ্ধা। লড়াই-সংগ্রাম আর রক্ত এবং আত্মদানে যে জাতি পেয়েছে নিজস্ব মানচিত্র, দেশমাতৃকা। কণ্ঠে তুলে দিয়েছেন সোনার বাংলার গান। লাল-সবুজে মেশা পতাকা দিয়েছেনÑযা পতপত করে আজও উড্ডীয়মান। জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে। স্বাধীনতা ও মুক্তি শব্দ দুটি ছিল তাঁর অতিপ্রিয়। জলদগম্ভীর স্বরে জাতির আত্মবিকাশ, আত্মস্বাধীনতা আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়কালে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দেবেনÑএই অভিপ্রায় থেকেই সংগঠন শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন। কখনো সাইকেলে, কখনো হেঁটে, আবার কখনো বা নৌকায় চড়ে গ্রামে-গঞ্জে গিয়েছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে। শক্তিশালী সংগঠন ছিল বলেই দলকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করতে পেরেছিলেন একাত্তর সালে। এমনকি স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এরও আগে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষকে মোকাবিলা করেছেন সুকঠিনভাবে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল শান্তির পরিবেশ তৈরির। আর এই সময়টাতে সবকিছু সুনসান হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলো ধরা দিতে থাকে ক্রমশ। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল দৃঢ়। তাই মনুষ্যবিবর্জিত কোনো কর্মকাণ্ড বাঙালি করবে, এ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাবনার জগতে অস্পৃশ্য। অথচ বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুরা তখনও ‘শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’ করে অস্ত্র শানিয়ে যাচ্ছিল ষড়যন্ত্রের নানা গুটি পাকিয়ে। দেশজুড়ে নানারকম অস্থিরতা, অরাজকতার যে ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তা নিরসনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপগুলো ততদিনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। কারণ, স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ে তোলার। অথচ স্বাধীন দেশে পরাজিত শত্রু ও ষড়যন্ত্রকারীরা শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে দেয়নি তাঁকে। প্রশ্ন জাগে এখনোÑস্বাধীন দেশের মাটিতে জাতির পিতাকে কারা হত্যা করল এবং কী কারণে? এর প্রকৃত ভাষ্য মেলে না। কিন্তু জাতির কাছে গত ৪৭ বছরে ক্রমশ তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু ঘাতকের নিঃশ^াস কি অনুভব করতে পেরেছিলেন? ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ^াস’, যিনি নিজেই জনসভায় আবৃত্তি করতেন, তিনি কি টের পাওয়ার সময়টুকু পেয়েছিলেন যেÑঘাতকরা যে কোনো সময়, যে কোনো মুহূর্তেই আঘাত হানবে। বিশ^াস তো ছিল তাঁর প্রখর যেÑকোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা দূরে থাক, আঘাত করার মতো মানসিকতা রাখে না। ভেবেছিলেন ‘সাড়ে সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি’র বিপরীতে তাঁর বাঙালি মানুষে পরিণত হয়েছে বলে স্বাধীন দেশে ফিরেই এই উচ্চারণ করেছিলেন। গুলি তাঁর বুকেই লেগেছিল, পিঠে নয়। ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল বুক। রক্তাক্ত লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। পালিয়ে যাওয়ার নন তিনি। তাই রাজনৈতিক সংগ্রামকালে বা একাত্তরের ২৫শে মার্চ তিনি যেমন পালিয়ে যাননি, তেমনই ১৫ই আগস্ট ভোরেও পালাননি। যদিও সেনাপ্রধান ফোনে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ রেখেছিল। কিন্তু তিনি নিজেই জীবন দিয়ে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। গ্রিক ট্র্যাজেডির চেয়েও বিয়োগান্ত ছিল পনেরোই আগস্টের নির্মম ঘটনাবলি। এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিবর্তনের জন্য কোনোভাবেই নয়। যার সাফাই গেয়েছিল স্বঘোষিত রাষ্ট্রপ্রধান মোশতাক, তার অবৈধ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল হিংসাত্মক প্রতিহিংসাপরায়ণতা। যার নেপথ্যে ছিল বিশাল ষড়যন্ত্র। এটা স্পষ্ট, এই ষড়যন্ত্র ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। যদি সরকার পরিবর্তনের জন্য হতো, তাহলে ১০ বছর বয়সী শিশু রাসেলসহ আরও শিশুদের হত্যার প্রয়োজন হয় না। এটা সন্দেহাতীত যে, এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ছিল। এবং তা প্রমাণিত হয় ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনায়ও। প্রতিহিংসামূলক হিংসাত্মক হত্যার প্রমাণ,বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে-পরে তাঁর গোটা পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে। এই হত্যাকাণ্ড যে সংবিধানের চার মূলনীতির বিরুদ্ধে ছিল, এর প্রমাণÑবাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশ এবং জয় বাংলাকে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ করার মাধ্যমে। খুনি ডালিমের কণ্ঠে ১৫ই আগস্ট সকালে বেতার থেকে উচ্চারিতও হয়েছিল ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দ। এবং এসবের প্রস্তুতি হঠাৎ করে নয়, পূর্ব থেকেই ছিল।
সাতচল্লিশ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মরণাঘাত করা হয়েছিল। বাঙালির স্থলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে এক কিম্ভূত জাতীয়তাবাদ প্রচলন করে তারা। সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা করা হয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার ঘটানো হয়েছিল, আর গণতন্ত্র তো সামরিকতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিল। সংবিধানের চার মূলনীতির অপমৃত্যু ঘটানো হয়েছিল। জামায়াতসহ অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দলের যারা যুদ্ধাপরাধী, তারা স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই পালিয়েছিল। তাদের প্রধান গোলাম আযম তেহাত্তর সালে লন্ডনে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ নিয়ে মাঠে নেমেছিল। প্রচুর অর্থকড়ি সংগ্রহ করে দেশে পাঠিয়ে অরাজক অবস্থা তৈরি করে চলছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে সামরিক জান্তা শাসক জিয়া। কিন্তু গণরোষের মুখে তখন নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারেনি। সেই তাদের সহযোগিতায় দেশকে পাকিস্তান ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। যারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা, পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতা করেছে, তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন শুধু নয়Ñসরকারের মন্ত্রীও করা হয়। যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানি দালালদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকাল শুরু হয়, যা একুশ শতকেও এই জান্তার উত্তরসূরিরা করেছে।
মহাবিপর্যয় ঘটানো হয়েছিল ১৫ আগস্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার। মুসলমানদের পবিত্র এই দিনে ঘাতকচক্র নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল পরিকল্পিত, নির্ধারিত এবং সুদূরপ্রসারী। আর এই হত্যাযজ্ঞের আয়োজক মাত্র কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা সদস্য, তা নয়। এর সঙ্গে অনেক গভীর পরিকল্পনা যে ছিল, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত পক্ষের মদদ যেমন রয়েছে, তেমনই আন্তর্জাতিক ও পাশর্^বর্তী ইঙ্গিত ও সাহায্য বা পরামর্শ থাকা যে সম্ভব, তা প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে। এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ছিল আমলা, বণিক, ধর্ম ব্যবসায়ী, বিভীষণ যেমন ছিল, তেমনই ছিল সেনারা। এসব ভ্রষ্ট, নষ্ট আর বিকৃতজনরাই দেশ ও জাতির মহাসর্বনাশ সাধন করেছিল। সাতচল্লিশ বছর পরও জাতি তার মাশুল দিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেখা গেছে, দেশজুড়ে অস্থির অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। সশস্ত্র রাজনৈতিক দলগুলো গুপ্তহত্যা, গুদাম-ফাঁড়ি লুট, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে হত্যা, খাদ্যবাহী বাহন ধংস করছিল গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টিসহ চীনাপন্থি দল। এসব গ্রুপ এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা অস্ত্রসহ চক্রান্তকারীদের সঙ্গে মিশে যায়। চারদিকে একটা বিদ্বেষ, কলুষ প্রচার-প্রোপাগান্ডা, মিথ্যাচার, গুজব ছাড়িয়ে অরাজকতার মাত্রা বাড়ানো হয়েছিল। দেশে নানা সমস্যা সৃষ্টি করেও যখন কোনোভাবেই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না, তখনই চরম আঘাত হানার পথ বেছে নেয়। দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে নানামুখী ও নানা মতলববাদী যার যার অবস্থা থেকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সুবিধা নেওয়ার পাঁয়তারা করে আসছিল। পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আবদুল হক ১৯৭৪ সালে ঢাকায় ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক শুধু নয়, শেখ মুজিব সরকার উৎখাতের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চেয়ে পরে ভুট্টোকে চিঠি লিখেছিল; যা ভুট্টোর জীবনীকার তার গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। ভুট্টোর ঢাকা অবস্থানকালে চীনাপন্থি দল ও গ্রুপগুলোর সঙ্গে তার সহযোগীদের বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে সরকার উৎখাতের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। সামরিক বাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা হত্যাযজ্ঞে জড়িত ছিল, যা বিচারে প্রমাণিত এবং রায়েও শাস্তি প্রদান করা হয়েছে কয়েকজনের। অনেকে এখনো পলাতক। এই ঘাতক চক্রের পরিকল্পনা ছিল সূদরপ্রসারী। বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিয়ে দেশে পাকিস্তানি ভাবধারা সৃষ্টিতে পঁচাত্তরের পরে তারা সক্ষম হয়েছিল। ঘাতকচক্র অন্তত এতটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু এবং তার নিকটজন বেঁচে থাকলে তাদের ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ সফল হবে না। তাই ঘাতকচক্র এগিয়েছে অত্যন্ত নিপুণ ও নিখুঁত ছকে। তারা লক্ষ করেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ ধ্বংসস্তূপ থেকে উন্নয়নের পথে এগোতে শুরু করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশটি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হাজারো বাধাবিঘ্ন মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটি স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে দ্রুতলয়ে। এখানেই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। দেশটির উন্নয়ন অগ্রগতি যে করেই হোক স্তব্ধ করে দিতে ‘জঘন্য কৌশল’ অবলম্বন করে ঘাতককুল। এই ধারণা প্রশ্নাতীত যে, দেশি ও বিদেশি শক্তিগুলো একত্রে কাজ করেই নির্মমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একাংশ যেমন, তেমনই আরও রাজনৈতিক দল হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি ও ষড়যন্ত্রে জড়িত কিংবা সহায়ক ছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে; কিন্তু হত্যাকাণ্ডের যারা পরিকল্পনা করেছে, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা পরিকল্পনা করেছিল, যারা তৎপরতা চালিয়েছিল, তাদের অনেকের বিষয়ই গত সাতচল্লিশ বছর ধরে আলোচিত হয়েছে। এই পরিকল্পনাকারীদের কর্মজীবন, রাজনৈতিক উত্থান, আদর্শ চিন্তা এবং তৎপরতা অনুসন্ধান করা গেলে বেরিয়ে আসবে অনেক দিগন্ত। অনেক গবেষকের কাছেই রয়েছে তথ্য-উপাত্ত। সিদ্ধান্তে আসার কাজটি সম্পন্ন হলে তাদের বিচারের আওতায় আনা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিরূপণে তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে অনেকদিন ধরেই। এমনকি হত্যাকাণ্ডের ওপর শে^তপত্র প্রকাশের দাবিও রয়েছে। এমনটাও বলা হচ্ছেÑবিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকাণ্ডে বিচারিক আদালতে বিচারের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কমিশন হয়েছে, যাতে পুরো ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়। এই কমিশন গঠন করা হয় হত্যাকাণ্ডের পুরো ষড়যন্ত্র যাতে জাতি জানতে পারে। আর রাষ্ট্র যাতে এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভবিষ্যতে যেন পতিত না হয়। আমরা দেখেছি জন এফ কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, ইন্ধিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সাতচল্লিশ বছর পর হলেও তদন্ত করা কঠিন নয়। অনেক অনুষঙ্গ, দলিলদস্তাবেজ, সাক্ষী এখনো রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ‘দেশপ্রেমিক’ ঘোষণাকারী খন্দকার মোশতাক ছিলেন এই ঘটনার মূল হোতা এবং সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। এই সুবিধার ভাগ তিনি জেনারেল জিয়ার সঙ্গে মিলেমিশে করেছেন। এই দুই সুবিধাভোগীই ছিল পরিকল্পনার প্রধান। দুজনের অবস্থান ভিন্ন হলেও এই একটি লক্ষ্যে তারা একাত্ম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন এদের ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা উন্মোচন করা হলে হত্যা পরিকল্পনার একটি সরলচিত্রও উন্মোচিত হতে পারে। মোশতাক-জিয়া দুজনেই যুদ্ধকালে বিরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। মুজিবনগর বা অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ার উদ্যোগী হয়েছিল। তার এই ভূমিকার কারণে সরকার তাকে নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। মোশতাকের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ ছিল যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এমনকি স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকার জাতিসংঘে যে পর্যবেক্ষক দল পাঠায়, তাতে মোশতাককে প্রতিনিধিদলের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আলোকপাত করেছেন যে, জিয়া-মোশতাকের ভূমিকা ছিল এই হত্যাকাণ্ডে। তাদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। একাত্তরের যুদ্ধ, স্বাধীতাপরবর্তী তাদের দুজনের ভূমিকা এবং পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়ার সব কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি। জিয়া ছিলেন পাকিস্তানের ভাবাদর্শের একজন সৈনিক। বাল্যকাল থেকে পাকিস্তানে বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, চাকরিজীবনে জিয়া আত্মস্থ করেছিলেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ। উনসত্তরের মাঝামাঝি জিয়া এদেশে আসেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যটি একাত্তরে সীমান্তে পাড়ি দিলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তার স্ত্রীকে ঢাকা সেনানিবাসে বহাল তবিয়তে সযত্নে রেখেছিল। স্বামীর ডাকে সাড়া দিয়ে সীমান্তও পাড়ি দেননি। জিয়ার আসল রূপ ফুটে উঠেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া ও মোশতাকের ভূমিকা উদ্্ঘাটনের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করা আবশ্যিক।
পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, জিয়া ক্ষমতা দখলের পরই দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের স্থান এবং পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের স্থানটি শিশু পার্কে পরিণত করেছিল স্বাধীনতার সব চিহ্ন মুছে ফেলার লক্ষ্যে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রক্ষায় মোশতাক-জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকা এবং বেনিফিশিয়ারি হওয়ার সুবাদে নিজেদের রক্ষার জন্য তারা এই পথ বেছে নিয়েছিল। পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়, জিয়া-মোশতাক একই লক্ষ্যে কাজ করেছে এবং হত্যাকাণ্ডে রাজনীতির একটা সম্পৃক্ততা ছিল। আর তা ছিল বলেই মোশতাক-জিয়াকে হত্যাকাণ্ডের পর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা পাকিস্তানি ভাবাদর্শে যে লালিত, তা তাদের কর্মে পরিস্ফুটিত। যুদ্ধকালেই পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে দূতিয়ালি করেছিল মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী গংরা, তাতে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে আনা এই প্রস্তাব ভেঙে গেলেও মোশতাকের তৎপরতা স্বাধীনতার পরও থেমে থাকেনি।
এমনটা মনে আসে, পনেরোই আগস্ট ভোরে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, তখন জিয়া-মোশতাক নিশ্চয় জাগ্রত ছিলেন অপেক্ষায়। যদি তাই না হবে, তবে ঘটনা সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে তারা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন কীভাবে? মোশতাক ভোরে বেতার কেন্দ্রে হাজির হয়ে ডালিমের ঘোষণার পর পরই ভাষণ দেন এবং নয়া সরকার গঠন ও ফরমান জারি করেন কীভাবে। দেখা যায়, তিন বাহিনীসহ বিডিআর প্রধানও দ্রুত আত্মসমর্পণ, হত্যাকারীদের সমর্থনসহ বেতারে ভাষণ দেন। তারা নিশ্চয় অবহিত ছিলেন, কী ঘটবে, কী ঘটতে যাচ্ছে এবং ঘটার পরের করণীয় এবং দৃশ্যপটে তাদের যথাসময়ে আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি। সবই হয়েছে দ্রুত। জেনারেল জিয়া সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে যে শপথ নিয়েছিলÑ তার চাকরির শর্তানুযায়ীÑ দেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিতার খবর অবহিত হলে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো। সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান অধিনায়ক হিসাবে জিয়ার তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, কিন্তু তা করেনি। বরং তাকে অবহিত করার জন্য আসা অপর সামরিক কর্মকর্তাকে তিনি রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার কথা শুনে বলেছিলেন নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে, ‘তাতে কী!’ স্বঘোষিত খুনি ফারুক ১৯৭৬ সালে আইটিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেছিল। কতিপয় মেজর সামরিক নিয়মানুযায়ী এবং সামরিক বিধি বলেই বহিষ্কৃত হয়েছিল। তারাই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনে ভূমিকা রেখেছিল। তাদের বিরুদ্ধে জিয়া-মোশতাক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, বরং তাদের পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। জিয়ার সামরিক আইন ও বিধি লঙ্ঘন এবং উচ্চাভিলাসিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ঘটিয়েছিল। মোশতাকসহ হত্যার পরিকল্পনাকারীরা কুমিল্লার ‘বার্ড’-এ যে গোপন সভা করতো, তাতে বাঙালি অফিসারও ছিল। তারা পাকিস্তান প্রশাসন থেকে বাংলাদেশ সরকারের সিএসপি/প্রশাসনে স্থানান্তর হয়। তাদের অতীত পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানি ভাবধারায় তারা নিমজ্জিত ছিল। একজন আমলার কবর তো পাকিস্তানে। আরেকজন এখনো পলাতক। যিনি যুদ্ধকালে মাহবুবুল আলম চাষীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন। নড়াইলের এডিসি থাকাকালে সীমান্ত পাড়ি দেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান থেকে, তাদের ভাষায় ‘পালিয়ে এসে’ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর এরাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। একজন তো সেনাবাহিনীর মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে রাজনীতিকদের শুধু নয়, ৭ নভেম্বর সেনা কর্মকর্তা হত্যা করতে পিছপা হয়নি। পাকিস্তানের কাকুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ‘যোদ্ধারা’ পাকিস্তানি চরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল স্বাধীনতার পর পরই। যুদ্ধকালে জিয়ার ভূমিকায় সেনাপ্রধান ওসমানী নাখোশ হয়েছিল কয়েকবার। সেই জিয়ার সঙ্গে মোশতাকের সংযোগ ঘটেছিল যুদ্ধকালেই। এসব অনুসন্ধান জরুরি। তারা সময় বেছে নিয়েছিল ১৫ আগস্ট ভোরকে। সূর্যোদয়ের পর বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সমাবর্তনে চ্যান্সেলর হিসাবে যোগ দিতে। এই অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার জন্য ১৪ আগস্ট বিকালে ও রাতে ঢাকা শহরে গণবাহিনী বোমাবাজি করে। হরতাল ডাকা হয়েছিল সশস্ত্র একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল। একটা মানসিক চাপ তৈরি করা হয় সেদিন। সমাবর্তনে যোগদানকে সামনে রেখে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও সে রাতের ঘটনা প্রমাণ করে না নিরাপত্তাব্যবস্থা সামান্যতম হলেও ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রহরার দায়িত্বও পরিবর্তন করা হয়েছিল। নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল একাত্তরের পাকিস্তান বাহিনীর হয়ে যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে থাকা পাকিস্তান প্রত্যাগত এক সেনা কর্মকর্তার অধীনস্থ ট্রুপকে। ঘটনার আগের দু’সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারা দেখা-সাক্ষাৎ করেছিলেন, কারা বঙ্গবন্ধুর তথ্য পাচার করতেন, তা অজানা রয়ে গেছে। দলের ভেতরে থাকা উপদল, গ্রুপ, উপগ্রুপগুলোর তৎপরতা-অপতৎপরতার ভেতর বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষ মাত্রা কতটুকু ছিল, তা অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে।
কেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রয়োজন ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের, তা গত সাতচল্লিশ বছরে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থান রয়ে গেছে অজ্ঞাত। তারও নেপথ্যে প্রকাশ্য নানা কারণ থাকতে পারে। সেদিন যার যা দায়িত্ব ছিল, তারা তা যথাযথভাবে বা সামান্যতম হলে পালন করেছিলেন, এমনটা জানা যায় না। মোশতাক ক্ষমতায় বসে বঙ্গবন্ধু প্রণীত সব ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটন করে পাকিস্তানি বিধিবিধান ও ধারা চালু করেছিল। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশগুলোর সমর্থন আদায়, গলাকাটা শ্রেণীশত্রু চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের উন্মুক্ত পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার সূচনা করে। জিয়া তার বিস্তার ঘটায়। দালাল আইনে আটকরা ছাড়া পেতে থাকে চিহ্নিত অপরাধীরা। যাদের দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা, তারাই খুনিদের প্রতি, মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে শুধু ব্যক্তি মুজিবকে নয়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটাকেও হত্যা করা হয়েছিল। ভূলুণ্ঠিত করা হয় মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সবকিছু। বঙ্গবন্ধুকে বহুবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়। ১৯৭৫ সালে ঘাতকরা সেই চেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। এখনো চক্রান্ত চলছে। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র উদ্্ঘাটন প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার লক্ষ্যে। আর এজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।