শিখা বিশ্বাস
তুরাগ নদী বিধৌত টংগী এলাকা। দেশের ঘনবসতি ও শিল্পনগরী হিসেবে টংগীর পরিচিতি দীর্ঘ দিনের। প্রায়৬০/৭০ বছরআগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ তার জীবিকার তাগিদে এই এলাকায় ছুটে এসেছে। বাংলাদেশ পূর্ববর্তী সময় থেকে এখানে গড়ে উঠে বিভিন্ন ভারী ও হাল্কা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। রাজধানী ঢাকার অতিসন্নিকটে হওয়ার কারণে এবং যোগাযোগ সুবিধার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এখানে গড়ে উঠে বিভিন্ন পোষাক তৈরীর কারখানা।
স্বল্প রোজগারের লোকেরা তাই এখানে কাজের সন্ধানে অবস্থান করে। এমনি বাস্তবতায় নিম্ন ও মধ্য বিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়াশুনার প্রধান মাধ্যম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । তাদের সন্তানেরা পড়াশুনা করে এই টংগী এলাকার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে। অনেকে আবার ঘনঘন এলাকা পরিবর্তন করে কাজের প্রয়োজনে বা তাদের জীবিকার প্রয়োজনে। সেজন্য এখানে ভাসমান লোকজন বা শিশুর সংখ্যাও বেশী। টংগী থানার প্রাথমিক শিক্ষার একটি শক্তিশালী ইতিবাচকদিক হলো বেশীরভাগ( সবগুলোনয়) বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক মন্ডলী রয়েছে।
করোনা কালীন সময়ে এই শিশুদের অনেকের বাবা-মা চাকুরী হারায়। কিন্তু অবৈতনিক শিক্ষা ও সরকারের উপবৃত্তির কারণে শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অনেক সুবিধা পায়। তাদের সাথে নিয়মিত মোবাইল ফোনে ক্লাস নেওয়া হতো। পরবর্তীতে যখন ১২-০৯-২০২১ খ্রি: তারিখে বিদ্যালয় খুলে দেয়া হয় তখন দেখা যায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সাবলীল পড়ায় বেশ দুর্বল। যে সমস্ত বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণীকক্ষ রয়েছে সেখানে একটি ক্লাসে দুজন করে শিক্ষক অবস্থান করে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই তৈরী করা হয় এবং শিখন ঘাটতি পূরণের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রতিটি শিশুকে আংগুল ধরে ধরে বর্ণ,শব্দ,বাক্য, শেখানো হয়। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তারা বাড়ি গিয়েও তাকে স্কুলে নিয়ে আসে। সম্মানিত শিক্ষকগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুল মুখী হয় এবং তার ফলশ্রুতিতে বেশ কিছু বিদ্যালয়ে শিশুরা শতভাগ রিডিং পড়তে পারে।
যেমন- হাজী সৈয়দ শাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একেবারে বস্তির ভিতরে অবস্থান। শিক্ষকদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুল বিমুখ শিশুদের নিয়ে আসা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর সবাই রিডিং পড়তে পারে।সিলমুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখানে ক্লাসরুম সংকট থাকলেও শিক্ষক ছিল। প্রতিক্লাসে দুজন শিক্ষক দুদিক থেকে শিশুদের সাবলীল পড়ায় সাহায্য করেছে। সাতাইশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও বনমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দুটি যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমন ৯৫% শিক্ষার্থী উপস্থিতি এবং সাবলীল পড়ায় পারদর্শি।আউচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে শ্রেণী কক্ষ ও শিক্ষক দুটোই থাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ছয় শতাধিক। এই এলাকায় আরো ভালো ভালো উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার পরেও সকল নিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং তাদের বাৎসরিক ফলাফল ও শিশুদের শিক্ষার মান সন্তোষজনক। পাগার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মরকুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমানে ৯৫% শিক্ষার্থী সাবলীল ভাবে পড়তে পারে এবং এই দুটি বিদ্যালয়ে ঝরেপড়া ১.২% ও উপস্থিতি ৯৫% যাহা আশেপাশের অন্য থানার বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশী।
এভাবে নিরলস চেষ্টার ফলে ৯০% শিশুরা এখন সাবলীলভাবে পড়তে পারে। এছাড়া প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে বাগান করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ছাদ বাগান কর হয়েছে। এতে শিক্ষাথীরা মনে আনন্দ পাচ্ছে। তারা গাছের যত্ন করা শিখেছে।ফুল বা ফল তারা নষ্ট করেনা।অভিভাবকগণের সাথে বার বার মতবিনিময় করার পরে তারা এখন বুঝতে পেরেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো পড়ালেখা হয়। প্রায় ৫০% বিদ্যালয়ে খেলার জন্য স্লিপার, ঢেকি এবং দোলনা আছে। শিশুরা এখানে প্রচুর বিনোদন পাচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা আগের চাইে তবৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঝড়ে পড়ার হার ১.২% অর্থাৎ ঝরে পড়ার হার কমেছে। শিক্ষকরা প্রায়ই তাদের বাড়ি বাড়ি যাওয়াতে তারা নিজেদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার পটভূমি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শুধু পাঠ্যপুস্তকই পড়ায়না এখানে শিশুদের বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক ,আধ্যাতিক, নৈতিক, নান্দনিক ও আবেগিক বিকাশ গুলোর দিকে খুব নজর দেয়া হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকারা যেমন তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ঠিক তেমনি ভাবেই মাঠ পর্যায়ের থানা শিক্ষা কর্মকর্তার দিক নির্দেশনা উক্ত থানার শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তারই পথ ধরে অত্র টংগী থানার থানা শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব শিখা বিশ্বাস এর কার্যক্রম প্রশংসনীয় ও উল্লেখযোগ্য।
লেখক- শিক্ষিকা