মলয় বিকাশ দেবনাথ
গতকাল ২২ শে শ্রাবণ ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। যার দ্বারা বিকশিত হয়েছিল সাহিত্যের প্রতিটি শাখা প্রশাখা। এবং সব কালেই যে তিনি প্রসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবেবিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়ভার যেমন আছে পাশাপাশি তিনি এখনও কতখানি প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য সেটাও স্পষ্ট হওয়া অত্যন্ত জরুরী। উনিশ শতকের সমৃদ্ধ সময়ে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ যে বিরাট ঐতিহ্যিক ধারায় নিজের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করে যৌবনের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছান তার যুগান্তকারী প্রভাব পড়ে সৃষ্টি আর সুবিশাল কর্মযজ্ঞে। জ্ঞানী-গুণীর মহাসম্মেলনে ঠাকুর বাড়ির নির্মল আবহ, ইউরোপীয় সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার আর আবহমান বাংলার চিরায়ত বৈভবের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকে নিজের পর্বত প্রমাণ প্রতিভা আর যুগোত্তীর্ণ সৃষ্টিশীলতা। নবজাগরণের নতুন স্রোতে অবগাহন করেও নিজস্ব কৃষ্টি আর সংস্কৃতিরও অনুগামী ছিলেন জীবনব্যাপী, নতুনকে বার বার স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু মাঙ্গলিক বিধিবদ্ধ আচার নিয়মকে কখনও উপেক্ষা করেননি। মানুষের অসম্মান আর অমর্যাদাকে মানতে পারেননি। ফলে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব আর সংঘাতে বিচলিত রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই সময়ের দাবি মেটাতে আগ্রহী ছিলেন। আর তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ইউরোপীয় সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে ধারণও করেছেন। মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনাকে সর্বমানুষের জীবনে যোগ করার প্রত্যয় ছিল বরাবরই। সাহিত্যের বহুমাত্রিক আঙ্গিনায় বিচরণ করা রবীন্দ্রনাথ সময়ের পরিবর্তনের ধারায় আজও বর্তমান প্রজন্মকে কতখানি উদ্বুদ্ধ করতে পারে তা তার সৃষ্টিশীলতা আর মননশীলতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁর কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধের ওপর আলোকপাত করলে এর সত্যতা উপলব্ধি করা যাবে। নিজের গান সম্পর্কে বলেছিলেন, তার গানের আবেদন চিরদিনের। আবহমান বাংলার মূল শেকড় থেকে তুলে আনা গানের কথা আর সুরের সঙ্গে যোগ হয়েছে সর্বভারতীয় আধ্যাত্ম চেতনা।
একইভাবে বিশ্ব সঙ্গীতের ছোঁয়া এসে লাগে তার কালজয়ী বাণীতে। যা আজও মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। নতুন প্রজন্মও মনে করে রবীন্দ্রনাথ তাদের কথাই বলছেন গানের মাধ্যমে। আর কবি হিসেবে অতুলনীয় আর অকৃত্রিম রবীন্দ্রনাথের কাব্য সম্ভার আজও আবেদন জাগিয়ে যাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে। তিনি নিজেই তাঁকে কবি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন। নোবেল বিজয়ও হয় কবিতার জন্য। ছিন্নপত্রে আছে, তিনি আসলেই কবি, কাব্য লক্ষ্মী তার আরাধ্য আর এই কবিতাই তার সমগ্র সত্যের একমাত্র আশ্রয়স্থল। আসলে রবীন্দ্রনাথ চিরকালের ভাব সম্পদ নিয়ে তার সৃজন ক্ষমতাকে এমনভাবে পূর্ণ করেছেন যার গ্রহণযোগ্যতা কমার কোন আশঙ্কাই থাকে না। আর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার হিসেবে তিনি আজও সৃজনশীলতার এই বিশেষ আঙ্গিনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং নাটকও সেই উনিশ শতক থেকে শুরু করে আজ অবধি সর্বমানুষের নানামাত্রিক চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ শুধু সমকাল কিংবা আধুনিক নন তিনি একেবারে চিরকালের। তাই তিনি প্রাসঙ্গিক, তার প্রয়োজন কখনও ফুরাতে পারে না। নতুন প্রজন্মের কাছে তো নয়ই। বিজ্ঞান সচেতন রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনের জীবন আর শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞানের যে নিগূঢ় সম্পর্ক সেটা তিনি অনুভব করতেন কিশোর বয়স থেকেই। ঠাকুর পরিবারে নিয়মিত আসা সীতানাথ দত্তই ছিলেন তার বিজ্ঞানের আদিগুরু। পিতা মহর্ষি তাকে ডালহৌসির পাহাড়ের ডাকবাংলোর আঙ্গিনায় বসিয়ে তারা নক্ষত্র আর গ্রহের সঙ্গে পরিচয় করাতেন। ‘বিশ্ব-পরিচয়’ গ্রন্থের ভূমিকায় কবি তা উল্লেখও করেন। আর সে সব নিয়ে তিনি কাঁচা হাতে একটি বড় প্রবন্ধ লিখেও ফেলেন। সেটাই তার প্রথম রচনা এবং তা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে। কৈশোরে যে বিজ্ঞান চেতনা তাকে আকৃষ্ট করেছিল জীবনের শেষ অবধি তা অক্ষুণ্ন ছিল। জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে কবির হৃদ্যতা ও নিরবচ্ছিন্ন বন্ধুত্ব সব সময়ই অটুট ছিল। আর বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতার কথা তো সবারই জানা।
বিজ্ঞান শুধু জানার, বোঝার কিংবা দেখার নয় তাকে নিজের আয়ত্তে এনে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত করাই সত্যিকারের বিজ্ঞান ভাবনা এবং চর্চা। আধুনিক উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রযুক্তিকে জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে মেলানোর তাগিদ যেমন নিজের মধ্যে ছিল একইভাবে তা সর্বসাধারণের উপযোগী করে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই তিনি মনে করতেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপকরণগুলো উন্নয়নের ধারায় সংযুক্ত করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ব। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, শিল্পোন্নত জাপান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগামী ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমণ করে এই ধারণা তাঁর আরও বদ্ধমূল হয়। শুধু মুষ্টিমেয় বিজ্ঞানীর জন্য এই বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশল নয় তা সার্বজনীন এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছেও পৌঁছে দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই চেয়েছেন যুগের প্রয়োজন, সময়ের দাবি এবং বিশ্ব পরিসরের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আয়ত্তে এনে সর্বসাধারণের মঙ্গল করা। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কবির এই বিজ্ঞান সচেতনতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিজ্ঞানের নব নব সৃষ্টির উদ্যোমের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী হয়ে সারা পৃথিবীর জ্ঞান চর্চা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হবে নিজেদের স্বার্থে। আধুনিক এবং অগ্রগামী চিন্তার নায়ক রবীন্দ্রনাথকে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে আসতে তার নিজের বিজ্ঞান মনস্কতাও তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরী। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার এবং তার সর্বশেষ অর্জন মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে না পারলে যুগ আর সময়কে ধরতে না পারার দায়ভাগ ও নিজেদের ওপর বর্তাবে। সুতরাং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সমস্ত সুফলকে আয়ত্তে এনে রবীন্দ্রনাথকে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় পৌঁছে দেয়া এখন সময়ের দাবি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ভাবতেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা যতই আধুনিক হবে, যতই উদ্ভাবনী শক্তির সম্ভাবনা মানুষের দ্বারে পৌঁছাবে ততই দেশ ও জাতি অগ্রগামী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।
রবীন্দ্রনাথের এই আধুনিক এবং বিজ্ঞান মনস্ক ধারণা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও কত প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তরুণ প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্ভারের নানামাত্রিক আয়োজন আজও আমাদের জীবনের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এমনকি প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে ঈশ্বর বন্দনা, প্রকৃতিপ্রেম, দেশাত্মবোধ, নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিম-ল থেকে শুরু করে বিশ্বজনীনতার যে সম্প্রসারিত পথপরিক্রমা সেখানে আজও তিনি সময়ের পথিক, যুগের নায়ক এমনকি বিশ্ব পরিসরেও একজন যথার্থ কর্ণধার। তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে সামগ্রিকভাবে নিয়ে আসতে হলে সুসংবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিতে এমনই নিমগ্ন আর আসক্ত সেখানেই রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। রবীন্দ্রনাথের আদর্শিক চেতনা আর চারিত্রিক বলিষ্ঠতার যে প্রতিফলন তার সুবিশাল সৃষ্টিযজ্ঞে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে তাকে অতি সহজ আর স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দিতে হলে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। যাতে রবীন্দ্র রচনাবলী হাতে না নিয়েই একজন তরুণ কিংবা তরুণী ওয়েবসাইট অনুসন্ধান করে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারে। বাংলাদেশে এই ধরনের কর্মপ্রক্রিয়া এখনও শুরু না হলেও ভারত সরকার ইতোমধ্যে অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধ এবং ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্ভার বিচিত্রা অনলাইনে সন্নিবেশিত করে। রবীন্দ্রনাথের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই মহৎ আয়োজনে অর্থায়ন করে। এ বিরাট প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে দ্য স্কুল অব কালচারাল টেক্সট এ্যান্ড রেকর্ডস, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা, রবীন্দ্র ভাবনা, শান্তি নিকেতন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার। এসব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগে এই বিরাট কর্ম পরিকল্পনা প্রযুক্তিনির্ভর করা হয়। এখানে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের বাংলা ও ইংরেজী রচনাবলী। যদিও চিঠিপত্র, বক্তৃতা, পাঠ্যবই এবং কিছু অনুবাদ এর সঙ্গে যুক্ত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ওপর কিছু বই এবং সাময়িকীর স্ক্যান কপিও এর সঙ্গে যুক্ত আছে। পুরো প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয়কারী হিসেবে ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী। সহযোগিতায় ছিলেন শঙ্খ ঘোষ কবি এবং প্রাক্তন অধ্যাপক।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন প্রকল্প কর্মকর্তার অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রায় ২ বছর সময় ব্যয় করে এই ওয়েবসাইট তৈরি করা হয় যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে সহজেই জানতে, বুঝতে এবং পাঠ করতে পারে। নতুন প্রজন্ম যাতে সময় ক্ষেপণ না করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসতে পারে তার জন্য ২০০৭ সালে পশ্চিম বাংলা সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের উপযোগী ওয়েবসাইট সংযোজন করে। যাতে এই ক্ষুদ্র প্রযুক্তিতেও রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে জানার সুযোগ থাকে। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা আজ বিশ্বজনীন। তার সৃজন ভা-ার এতই আধুনিক, সার্বজনীন এবং চিরস্থায়ী যা তাকে এখনও সফলভাবে মানুষের কাছে নিয়ে আসে। সব বয়স এবং পরিবেশের নিরিখে তিনি এতটাই গ্রহণযোগ্য যে তাকে বাদ দিয়ে গান, কবিতা, গল্প কিংবা নাটক কল্পনাই করা যায় না। সময়ের মিছিলে এগিয়ে যাওয়া মানুষের অভ্যাসও এক জায়গায় স্থির থাকে না। ফলে পাঠাভ্যাসেও এসেছে নতুন সংযোজন। প্রতিষ্ঠিত কিংবা জনপ্রিয় গ্রন্থাগারে বই অনুসন্ধান করা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। বই হাতে আসতে এত সময় ব্যয় হয় আধুনিক গতিশীল জীবনযাত্রায় তার প্রভাব পড়ে নেতিবাচক। অথচ রবীন্দ্রনাথের মতো কৃতী পুরুষদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থেকে এখনকার প্রজন্ম সুস্থ এবং সাবলীল ধারায় বিকশিত হতে ব্যর্থ হবে। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রযুক্তিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে সেখানে হাতের মুঠোয় সারা পৃথিবীকে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকেও। এখনকার ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটের প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষিত হচ্ছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সামান্য সময় ব্যয় করে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সমস্ত উপাত্ত হাতের নাগালে চলে আসে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড কিংবা স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতাকে শুধু নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে চলবে না। সামগ্রিকভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং গুরুত্বকেও বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় বিজ্ঞানের সমস্ত সুফল আর সর্বশেষ অর্জনকে প্রতিদিনের কর্ম আর জীবন প্রবাহে মেলাতেই হবে। আর এভাবেই রবীন্দ্র অনুসন্ধানও চলতে পারে। ইতোমধ্যেই তাকে নিয়ে ওয়েবসাইটের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ শুরু হয়ে যায়। যেমন ইউটিউবে তার সমস্ত গান শোনা যায়।
ই-বুকে তার সামগ্রিক রচনাবলী সংযোজন করা হয়েছে। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের ঋতুবৈচিত্র্যের যে সঙ্গীত সম্ভার সেখানেও তিনি অজেয় এবং তার গান অক্ষয় ঐশ্বর্য। যা আজ নতুন প্রজন্ম মুহূর্তের মধ্যে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। শুধু দেশেই নয়, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশ্বজনীনতার যে অপার সম্ভাবনা ছিল সেখান থেকে তাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ারও একটা গুরুত্ব সামনে এসে যায়। আর সেটা সম্ভব পৃথিবীর বিভিন্ন জনপ্রিয় ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলীকে অনূদিত করা। ইংরেজীতে ইতোমধ্যে করা হয়েছে। যা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথকে চেনাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া জার্মান, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং জাপানের মতো শিল্পোন্নত ও আধুনিক দেশগুলোর ভাষায়ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। তিনি নিজেও এসব দেশ সফর করেছেন এবং সকলেই তাঁকে চেনে, জানে। সুতরাং এসব দেশেও রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা এখনও শেষ হয়নি বলে আমাদের বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় সৃষ্টির প্রতি পাঠকের নজর যে বৈজ্ঞানিক শক্তি রবীন্দ্রনাথকে জীবনভর উদ্দীপ্ত করেছে জীবন আর কর্মের প্রতিটি পর্যায়ে যে উদ্ভাবনকে সম্পৃক্ত করার তাগিদ অনুভব করেছেন সেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিই আজ কবিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নিয়ে আসবে। প্রযুক্তিগত নব আবিষ্কার আধুনিক প্রজন্মকে জ্ঞানচর্চার যে সুবর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে সেটাকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যত সন্তানরা রবীন্দ্রনাথের সুবিশাল সৃষ্টিযজ্ঞে নিজেদের নিমগ্ন করবে। অনলাইনের বিভিন্ন পর্যায় ব্যবহার করে কবির উল্লেখযোগ্য আর গুরুত্বপূর্ণ সৃজনভা-ারকে তুলে ধরতে হব। ভারতে সরকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই কর্মপরিকল্পনা ইতোমধ্যে সর্বসাধারণের আয়ত্তের মধ্যে চলে আসে। একে আরও ব্যাপক এবং সম্প্রসারিত করে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এই ধরনের মহৎ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইউটিউবে ও রবীন্দ্র চর্চা হতে পারে। শুদ্ধ রবীন্দ্র অনুসন্ধানে যাতে কোন ভুলভ্রান্তির অবকাশ না থাকে। রবীন্দ্রনাথের লেখাকে কোনভাবেই ত্রুটিবিচ্যুতির আবর্তে ফেলা যাবে না। কারণ অনলাইন থেকে যখন রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতা, গল্প কিংবা প্রবন্ধের অংশা বের করা হয় সেখানে অনেক ভুল দৃশ্যমান হয়, যা কোনভাবেই হওয়ার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু জনপ্রিয় গান, কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, নৃত্য আর গীতিনাট্য আছে যার আবেদন আজও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, আলোড়িত করে, ভাল লাগায়। বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্যকে সব দিক থেকে গুছিয়ে সহজে তথ্যপ্রযুক্তিতে সংরক্ষণ করা কঠিন। তাই কিছু কিছু নির্বাচিত রচনা প্রাথমিক অবস্থায় নতুন ওয়েবসাইট খুলে সাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া যায়। প্রথমেই গানের কথায় আসা যাক। কবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার গান মানুষ সব সময়ই শুনবে। এর আবেদন কখনও ফুরাবে না। শতবর্ষের ওপর আজও মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে, মনপ্রাণ দিয়ে এই গান উপভোগ করে, তার কথা আর সুরে একাত্ম হয়ে যায়। গীত বিতানের অসংখ্য গান ওয়েবসাইট থেকে নামানো যায়। যা এই সময়ের প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আজও মানুষের মনকে নাড়া দেয়, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে, আবৃত্তি করে, শৈল্পিক ছন্দে বিভোর হয়। ‘সোনার তরী’র মতো কাব্য সম্ভার বাংলা সাহিত্যের এক অনুপম সম্পদ। সোনার তরীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাংলার প্রমত্ত প্রদ্মা আর গ্রামবাংলার অপার মাধুর্য।
এই ‘সোনার তরীর’ আবেদন এখনও কবিতাপ্রেমিকদের নিবিষ্ট করে রাখে। যা ওয়েবসাইটে সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা যায়। যা আজকালকার ছেলেমেয়েদের হাতে নির্বিঘ্নে, সহজভাবে এসে যাবে। এই বাংলায় বসে লেখা ‘চিত্রা’ কাব্য সমকালকে উত্তীর্ণ করে আজ পর্যন্ত কবিতার আঙ্গিনায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ভাস্বর। বিশেষ করে ‘দুই বিঘে জমি’ ‘পুরাতন ভৃত্য’ কিংবা ‘এবার ফিরাও মোরে’ নয়ত বা ‘সিন্ধু পারে’ কবিতা গুচ্ছ পাঠকের নজর কাড়ে, ছন্দে আর শৈল্পিক শৌর্যে যে কাব্যিক আবহ তা কালের প্রবাহে আজও অম্লান। একইভাবে গীতাঞ্জলি, নৈবদ্য কিংবা চৈতালী, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা ‘পুরবী’, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর স্মরণে ‘স্মরণ’ নারী নিগ্রহের কঠিন চিত্র ‘পলাতকা’ আধুনিক নারী চেতনার ‘মুহুয়া’, আরও আছে পুনশ্চ, সাধারণ মেয়ে হঠাৎ দেখা, শিশু কাব্যে ছড়িয়ে থাকা মাতৃ মহিমার ছবি, সামান্য ক্ষতি, দেবতার গ্রাস, বিসর্জনের মতো অতি পরিচিত এবং পাঠক নন্দিত কবিতা নতুন প্রজন্মকে নব আনন্দে ভরিয়ে তুলবে। স্মার্টফোনে বিশেষ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের রচনা সংরক্ষণ করা সম্ভবপর। বিভিন্ন কোম্পানি এই ব্যবস্থার অংশীদার হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বৈচিত্র্যের আর এক অমূল্য সম্পদ তার হাত দিয়ে তৈরি হওয়া বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের এক সমৃদ্ধ অবয়ব। যার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পাঠক এখনও অপূর্ব এক আবেশে আবিষ্ট হয়। তার ছোট গল্পের চিরায়ত ভাব-সম্পদ যা যুগের আবেদন মিটিয়েও শাশ্বত এক শৈল্পিক চৈতন্যে পাঠকদের যে মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায় তা যেন এক নান্দনিকতার অভিনব সৃজনসৌধ। ছোট গল্পের যে ধারা তিনি বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিলেন সেখানে আজও তিনি মহানায়কের ভূমিকায়। অনেক ছোট গল্পের রসসম্ভোগে পাঠকচিত্ত যেভাবে উদ্বেলিত হয় তা নির্দিষ্টকালের পাঠককে শুধু অতিক্রমই করেনি চিরকালের অম্লান ঐশ্বর্য হিসেবে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দীপ্যমান। সমকালীন সমাজের বাস্তবতা আর ঘাত প্রতিঘাতকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে চিরকালীন আবেদন যেভাবে পরিস্ফুট হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ একজন যুগোত্তীর্ণ স্রষ্টার ভূমিকায় ভাস্বর। আঙ্গিকে আর বৈশিষ্ট্যে ‘দেনা-পাওনা’ তার প্রথম সার্থক ছোট গল্প যা পণপ্রথার অভিশাপে জর্জরিত হয়ে বর্তমান সমাজেরও রূঢ়চিত্রকে মূর্ত করছে।
সমাজের এসব জঞ্জাল যতদিন অপসৃত না হবে ততদিন রবীন্দ্রনাথের এই বাস্তবোচিত সূক্ষ্ম অনুভূতি পাঠকের হৃদয়ে দাগ কেটেই যাবে। ‘কাবুলিওয়া’ আজও পিতৃস্নেহের এক অভূতপূর্ব রূপকল্প যা পাঠককে নানামাত্রিকে আলোড়িত করে। অজ পাড়াগাঁয়ের সামান্য সাধারণ অবোধ বালিকা রতনকে নিয়ে ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পের যে ঘটনা পরম্পরা পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয় তার কোন তুলনা কি হতে পারে? ছিন্নপত্রে আছে এই পোস্টমাস্টার তার শাহজাদপুরের কাছারিতে কর্মরত ছিল। রতনের নির্মল ভালবাসায় পাঠক সমাজ ব্যাকুল হয়, বিষণ্ন্ন হয় যা মানুষের হৃদয়বৃত্তি এক চিরকালীন ভাবসম্পদ। সেটা কখনও নির্দিষ্টকালে আবদ্ধ থাকে না। একেবারে কাছ থেকে দেখা মৃন্ময়ীকে নিয়ে লেখা ‘সমাপ্তি’ গল্পটি জীবনের চিরস্থায়ী অনুভবগুলো নানামাত্রিকে পাঠককে অভিভূত করে যা কখনই পুরনো হয়ে যেতে পারে না। তাই আজও রবীন্দ্রনাথ নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য। রবীন্দ্রসাহিত্যকে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরী। সামাজিক অভিশাপ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, উগ্র মৌলবাদীদের অপ্রয়োজনীয় উত্থান, অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অবাধ আর মুক্ত করতে রবীন্দ্রচর্চার কোন বিকল্প নেই। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে অতি সহজেই বর্তমান তরুণ-তরুণীদের কাছে নিয়ে আসা যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে ব্যাপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। ‘শাস্তি’ গল্পটি আজও বিভিন্নভাবে পাঠককে তাড়িত করে, উদ্বিগ্ন করে, বিষণ্ন আবেশে বেদনাহত করে। চন্দরার চারিত্রিক বলিষ্ঠতায় পাঠকরা চমৎকৃত হয়, বিস্ময়ে অভিভূত হয়। সত্যিই গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন শক্ত ধাঁচের অবিচলিত নারী ব্যক্তিত্ব ভাবাই যায় না। সে বিস্ময়ের ঘোর তো আজও কাটে না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো নিজস্ব সৃষ্টি ধারায় কবির যে অদ্ভুত নির্মাণশৈলী তা কালকে অতিক্রম করে চিরস্থায়িত্বের মহিমান্বিত আবেগ নিয়ে পাঠককে অভিভূত করে, সচকিত করে, গল্পের সার বার্তায় পাঠক আচ্ছন্ন হয়। ‘ছুটি থেকে আরম্ভ করে ইচ্ছেপূরণ’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘বোষ্টমী’, ‘নষ্টনীড়’ ‘অপরিচিতা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘দর্পহরণ’, ‘বিচারক’, ‘আপদ’, ‘দিদি’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘নষ্টনীড়’, ‘ল্যাবরেটরি’, ‘বদনাম’, ‘বলাই’, ‘রবিবার’সহ আরও অনেক গল্প যা প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ,আনন্দ-বেদনা আর অনুভূতির সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থার নিগূঢ় বন্ধনও সফলভাবে কবির দক্ষ শৈল্পিক দ্যোতনায় নির্মিত হয়। শুধু সৃজনক্ষমতাই নয় মননশীলতারও এক প্রতিভাদীপ্ত শক্তি কবিকে সারাজীবন উদ্দীপ্ত করে। যার স্বাক্ষর তার অসংখ্য প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলো প্রাচীন সমাজ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক পর্যন্ত বিদ্যমান ব্যবস্থার এক স্বচ্ছ প্রতিবেদন। সেখানে আধ্যাত্ববাদের দেশ বলে খ্যাত ভারতের চিরায়ত ধর্ম সাধনার এক নির্মল অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদের শুরু হওয়া থেকে মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের এক ধারাবাহিক কালপর্ব কবির সুচিন্তিত মননের এক অনবদ্য রচনাশৈল। প্রাচীন আর মধ্যযুগের বিরাটকালপর্ব অতিক্রান্তের সন্ধিক্ষণ, আধুনিকতার নব্য ধারার সূচনা থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর নতুন জোয়ারের সময়ে পথিকদের যুগান্তকারী অবদানকে বিভিন্ন প্রবন্ধে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলিষ্ঠ ভূমিকা নানা মাত্রিকে কবির চিন্তাশীলতাকে ভাবিত করে, তাড়িত করে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক ধারা, মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রেম আর ভক্তির রস পেরিয়ে নতুন যুগের বর্ণিল ঘটনা স্রোতের উন্মোচন কবির চিন্তার জগতে যেভাবে স্থায়ী প্রভাব ফেলে তাও তার প্রবন্ধ সমূহের এক অনুপম মননশক্তি।
‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ থেকে শুরু করে ‘সভ্যতার সঙ্কট’ পর্যন্ত তার মননশীলতার যে পর্যায়ক্রমিক ধারা সেখানে শুধু তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাকেই চেনাবে না এমন ঘটনা পরম্পরায় কবির বেড়ে ওঠা, নিজেকে তৈরি করা, এসবও পাঠকদের সামনে স্পষ্ট হয়। ভ্রমণ বিলাসী রবীন্দ্রনাথ মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিলেত যান। সেখান থেকে জ্যোতিদাদাকে লেখা পত্রাবলী নিয়ে প্রকাশ পায় ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’। সেখানে উদীয়মান তরুণের নতুন ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ এবং উচ্ছ্বাসের যে বর্ণনা তা আমাদের পাঠকদের ভিন্নমাত্রার আনন্দ দিতে পারে। বর্তমান প্রজন্মকে উৎসাহিতও করা যেতে পারে কবির এই নব উদ্যোমে। ‘আমার ছেলেবেলা’ আর জীবন স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে আছে সমকালীন সমাজ, ঠাকুর বাড়ির ঐতিহ্য, নব্য সংস্কৃতির প্রভাব সর্বোপরি এসবের মধ্যে কবির বেড়ে ওঠার এক সাবলীল প্রত্যয়। যা অনন্য রবীন্দ্রনাথ হওয়ার এক জীবন্ত কাহিনী সম্ভার। ১৯৩০ সালে বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ভ্রমণের রচনা সম্ভার ‘রাশিয়ার চিঠি’ সমাজ আর মানুষের অবিচ্ছেদ্যতায় এক নতুন গঠন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছ দলিল। ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ সঙ্কলন ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন এবং এর থেকে বের হওয়ার যথার্থ পথনির্দেশনাসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর সচেতন অভিব্যক্তিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার এক অসাধারণ সামাজিক দলিল। উপন্যাস পরিক্রমায়ও রবীন্দ্রনাথ একজন সিদ্ধ পুরুষ। সেখানে ‘চোখের বালি’ থেকে শুরু করে ‘চার অধ্যায়ের মতো আধুনিক মননের উপন্যাস তৈরিতে তার ভূমিকা আজও অনস্বীকার্য। উপন্যাসের বিস্তৃত বলয়েও তিনি নতুন প্রজন্মকে আগ্রহান্বিত করে তুলতে পারেন। যদিও তার উপন্যাসের সংখ্যা কম। মাত্র ১৪টি। চোখের বালির বিনোদিনী, ঘরে বাইরের বিমলা, নৌকাডুবির কমলা, যোগাযোগের কুমু কিংবা চতুরঙ্গের দামিনী আজও পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। আর শেষের কবিতার লাবণ্য-অমিত এবং চার অধ্যায়ের এলা তো কবির আধুনিক মননের চিরস্থায়ী দীপ্তি যা এখনও নতুন প্রজন্মকে নবজাগরণে উদ্ভাসিত করতে পারে। ‘গোরা’ উপন্যাস সমকালীন সমাজ থেকে শুরু করে বিদ্যমান সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আচার আচরণ, ধর্মীয় চেতনা আর দেশাত্মবোধে উদীপ্ত এক মহাকাব্যিক আখ্যান যাকে কোন সময়ের আবর্তে বেধে রাখা যায় না। এসব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। আর বর্তমান প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের চিরস্থায়ী সৃষ্টি সম্ভার পৌঁছে দেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। আধুনিক উদ্ভাবনী শক্তির বলয়ে তৈরি হওয়া নিত্যনতুন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেই তাঁকে সবার একান্ত নিকটে নিয়ে আসতে হবে। তাঁকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, সেই নির্দেশনায় ভবিষ্যত কর্মপন্থাও তৈরি করতে হবে। জাতির মহাসঙ্কটে, উৎসবে কিংবা অপার আনন্দেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা, নিত্যকর্মযোগ এবং চিরকালের ঐতিহ্য্। তাঁকে ধারণ করতে পারলে আধুনিক প্রজন্ম নিজেদের সমৃদ্ধ করবে, তাদের চলার পথ নির্বিঘ্ন হবে।লেখক- সাংবাদিক