এসএম ইমরান হোসেন
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন পরিবারে আলো করে আসেন তৃতীয় সন্তান ‘খোকা’। কেউ হয়তো বা কল্পনাই করেননি এই ‘খোকা’ পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠবেন বাঙালি জাতিসত্তার ভাগ্যবিধাতা। মা-বাবার আদরের সেই ‘খোকা’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে হয়ে উঠলেন পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক। তবে ‘খোকা’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেই। রাতারাতি এটি ঘটেনি। নানা চড়াই-উৎরাই এবং ঘাত-প্রতিঘাতের কঠিন পথের মধ্য দিয়ে সেটি সম্ভব হয়েছিল।
মূলত. নেতৃত্বের গুণাবলি এবং মানুষের সুখ-দুঃখের সমব্যথী হওয়ার বিরল গুণাবলি নিয়েই জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন তরুণ প্রজন্মের জন্য দারুণ এক অনুপ্রেরণা। জীবনে কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বাঙালি জাতিকে কখনো বিশে^র কাছে ছোটো হতে দেননি। মূলত ছাত্রজীবনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। ১৯৩৯ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শন করতে এলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে স্কুলের ছাদ মেরামত এবং ছাত্রাবাস নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে ন্যায্য দাবি তুলতে একটুকু কুণ্ঠিত হননি বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’Ñ এমন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানান বঙ্গবন্ধু। শাসকের রক্তচক্ষুকে তিনি কখনো ভয় পাননি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যারা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে মুচলেকা দিয়ে অন্যরা ছাত্রত্ব বজায় রাখলেও বঙ্গবন্ধু নীতির সঙ্গে আপস করেননি। তিনি কোনো মুচলেকায় সই দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নীতির প্রশ্নে আপসহীন এক বঙ্গবন্ধুকে আমরা চিনতে পাই। যিনি ন্যায়ের প্রশ্নে নিজের আইন পেশার ক্যারিয়ারকে তুচ্ছ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে একটি জাতিকে সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন। বলা হয়ে থাকে, যখনই কোনো মানুষ বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে এসেছেন, তখনই তাদের প্রত্যেকের মনে একধরনের গভীর ছাপ রেখে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। জীবনের একটি বড়ো অংশ তিনি কাটিয়েছেন জেলখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে। যে সময় বাইরের খোলা আলো-বাতাসে থেকেছেন, সেই সময়টাও পরিবারের সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে পারেননি। শাসকের রক্তচক্ষু আর গোয়েন্দার দল তাঁকে অনুসরণ করেছে ছায়ার মতো। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিল তিনি অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তিনি সবকিছুর গভীরে প্রবেশ করতে পারতেন মুহূর্তের মধ্যে। তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন কোনোভাবেই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ অবিচল কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ বস্তুত এটিই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার একটি মেসেজ লোক মারফত দিয়ে যান: ‘এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যাই তোমাদের হাতে আছে, তার দ্বারাই শেষমুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তিটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ এটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তিনি জানতেন এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তাই সব ধরনের প্রস্তুতি তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, সেটি তিনি তাঁর নেতাকর্মীদের ভালোভাবেই নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে প্রবাসী সরকার। পৃথিবীর নানা প্রান্তে সরব হয়েছে বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে বীর বাঙালি। গ্রামের কিশোর, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, পাড়ার বখাটে, বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-সবাই লড়েছে কাঁধে কাঁধ রেখে। এই জনযুদ্ধের মূল ভাবনাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি জানতেন এই জনযুদ্ধে জয় আমাদেরই।
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর পাকিস্তানিরা যে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে, সেটিই স্বাভাবিক। খোদ বঙ্গবন্ধুও জানতেন পাকিস্তানিরা তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। তবে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি পাকিস্তানিরা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিজয়ী বাংলাদেশ। তবে ৩০ লাখ শহিদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের ত্যাগে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। আমরা কি একবার ভাবতে পারি, ৩০ লাখ মানুষ হাতে হাত রেখে ব্যারিকেড তৈরি করলে সেটি কতশত মাইল লম্বা হয়? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর প্রাণের দেশে, যে দেশের মানুষকে তিনি নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। দেশে ফিরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে তিনি নতুন করে গড়ে তুলতে চাইলেন। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ালেন। এই সময়ে তিনি দেশের ভেতরে যেখানেই গিয়েছেন, সবখানেই একটি দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ই ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানতেন কাজটি কঠিন। দেশের ভেতরে পরাজিত শক্তি ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র। যাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশকে স্বাধীন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া এই স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা নানাভাবে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই কি ছিল প্রাপ্য? একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার এই কি পরিণাম? পাকিস্তান আমলে তিনি বছরের পর বছর কাটিয়েছিলেন জেলে এই ভেবে যে, একদিন দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে, তাঁর নিজের দেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে, সেটি কি ভাবা সম্ভব? আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে পেরেছি; কিন্তু খুঁজে বের করতে পেরেছি কি কাদের ষড়যন্ত্রে সেদিন তিনি নিহত হয়েছিলেন? কারা ছিল এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড? আমরা যদি সেটি খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হই তবে আমাদের বিচারের কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন আমাদের ভালোবাসায়। যে আদর্শ তিনি আমাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন, সেই আদর্শের পথ ধরেই তরুণ প্রজন্ম একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বেই।
লেখক : শিক্ষক, টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়